আজ - শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, (গ্রীষ্মকাল), সময় - দুপুর ১:১২

করোনা: ব্রাজিলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে, দিনে মারা যেতে পারেন ৫০০০, বিশ্বের জন্য হুমকি

ব্রাজিলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মৃতদেহ সমাহিত করতে গোরখোদকরা রাতদিন গর্ত খুঁড়ছেন। প্রতি মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পি১ রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রাজিল উচ্চ মাত্রার এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে যে ট্রাজিডি দেখা দেবে তা বিশ্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। তারা বলছেন, যদি এই ভাইরাস মুক্তভাবে বিস্তার লাভ করে, তাহলে তা অবাধে ব্রিডিং বা রূপান্তরের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এতে নতুন নতুন যেসব ভ্যারিয়েন্ট আসবে তা হবে আরো ভয়ানক। এ নিয়ে উদ্বেগ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।এতে বলা হয়েছে, প্রায় এক বছর আগে ব্রাজিলে অ্যামাজন জঙ্গলের ভিতর অবস্থিত মানাউস শহর আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। গণহারে লাশ সমাধি করার খবরে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশ্ব মিডিয়া। এবারও সেই চিত্র ফিরেছে ব্রাজিলে। বছরের শুরুতে অস্বস্তিকর দ্বিতয় ঢেউ শুরু হয়েছে সেখানে। মৃতের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছেই। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার মাত্র ২৪ ঘন্টায় সেখানে ৪২৪৭ জন মারা গেছেন। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি এখন বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারায় এপ্রিলে প্রতি একটি দিনে সেখানে ৫ হাজার করে মানুষ মারা যেতে পারেন।

সবচেয়ে ভয়াবহতা ছড়িয়েছে ব্রাজিলিয়ান অ্যামাজনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পি১ ভ্যারিয়েন্ট। এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে ব্রাজিলের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এগ্রিকালচারাল টেকনোলজির ভাইরোলজিস্ট এবং গবেষক হামবার্তো দেবাত বলেন, আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। মাত্র কয়েক মাসে ব্রাজিলে যে ভয়াবহ হারে মানুষ মারা যাচ্ছেন, তাতে আমরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কিন্তু এই ভাইরাসের ভয়াবহতাকে এখনও খাটো করে দেখছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসনারো। এমন পরিস্থিতির জন্য তাকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। এমনকি মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়ে ডানপন্থি এই নেতা স্বাস্থ্যকর্তাদের আহ্বান উপেক্ষা করেছেন। তারা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন জাতীয় লকডাউন দিতে। কিন্তু তিনি তা শোনেন নি। তিনি মাস্ক পরার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বিজ্ঞানকে অবহেলা করেছেন। অপ্রমাণিত এমন অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার কথা বলেছেন। এ সপ্তাহে তিনি মৃতদের সম্পর্কে বলেছেন- যেটুকু দুধ পড়ে গেছে তার জন্য কান্না করার দরকার নেই। অর্থাৎ যারা মারা গেছেন, তাদের জন্য কান্না করার দরকার নেই। তার এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন সাও পাওলোতে ফেডারেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইথেল ম্যাসিয়েল। তিনি বলেছেন, এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য যে, আমরা অবজ্ঞা প্রকাশকারী একজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছি। তিনি বিজ্ঞান মানতে চান না। জনগণকে বিধিনিষেধ মানতে উদ্বুদ্ধ করেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রাজিলের মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্বের অভাব আছে। এ কারণে করোনা ভাইরাস রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে রূপ পাচ্ছে। ২০২০ সালের জুন থেকে ব্রাজিলে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দিনে গড়ে এক হাজার দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটা বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বর্তমানে। কয়েক মাস ধরেই সেখানকার জনগণ গণপরিবহনে গাদাগাদি করে চলাচল করেন। তারা সমুদ্র সৈকতে, বার এবং নাইটক্লাবে ছুটে যান। কোনো বিধিনিষেধের বালাই নেই। ২০২০ সালের শেষের দিকে সেখানে অ্যামাজন সম্পর্কিত ভ্যারিয়েন্ট পি১ শনাক্ত হয়। কয়েক সপ্তাহ পরেই মানাউসের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফায়োক্রুজ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, জনবহুল রিও ডি জেনিরো এবং সাও পাওলোতে যারা করোন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন পি১ ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা। তিন মাস আগে এই হার ছিল শূন্য।

ব্রাজিল একটি টাইম বোমার ওপর বসে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যে গতিতে পি১ ভ্যারিয়েন্ট ছড়াচ্ছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা ও বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এই ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ছড়াতে পারে এবং বিশ্বের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রিও ডি জেনিরোর ফায়োক্রুজ থেকে মহামারি বিশেষজ্ঞ ডানিয়েল ভিল্লেলা বলেন, এই ভাইরাস পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক রাজ্যে আইসিইউয়ের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি সিট রোগীতে পূর্ণ। সেখানে ওষুধ এবং অক্সিজেন সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব কারণেও মৃতের সংখ্যা বেশি বলে তিনি মনে করেন।

ব্রাজিলে করোনার টিকা দেয়ার কর্মসূচি বেদনার। অব্যবস্থাপনা এবং জরুরি অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না প্রেসিডেন্ট বোলসনারো। এতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ব্রাজিলে জনসংখ্যা ২১ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগের সামান্য কম মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। ভিল্লেলা বলেন, এখন একমাত্র উপায় হলো দ্রুতগতিতে টিকা দেয়া। প্রয়োজন জাতীয় ভিত্তিতে কোভিড বিষয়ক প্রোটোকল। কিন্তু বুধবারও জাতীয় পর্যায়ে লকডাউনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রেসিডেন্ট বোলসনারো। ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংক্রমণের হার অব্যাহতভাবে আকাশচুম্বী অবস্থায় চলে যেতে পারে। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের মহামারি বিশেষজ্ঞ এরিক ফেইজল-ডিং বলেন, পি১ ভ্যারিয়েন্ট খুবই গুরুত্বর। ব্রাজিল নতুন, আরো বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট থেকে মুক্ত এমনটা বলা যাবে না। যত বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তত বেশি রূপান্তর দেখতে পাচ্ছি আমরা।

বুধবার এক গবেষণায় বলা হয়েছে চীনের দেয়া সিনোভ্যাক টিকা পি১ স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে শতকরা ৫০ ভাগ কার্যকর হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা দিচ্ছেন। তারা বলছেন, যে গতিতে এই ভাইরাস রূপান্তরিত হচ্ছে তাতে বর্তমান টিকা দেয়ার যে কার্যক্রম তাতেও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। ফায়োক্রুজ অ্যামাজোনাসের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ফেলিপে বাভেকা বলেছেন, মঙ্গলবার ৪০০০ ব্রাজিলিয়ান মারা গেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে এই ভাইরাস কত বেশি পরিমাণে বিস্তার লাভ করছে, রূপান্তরিত হচ্ছে এবং দ্রুততার সঙ্গে তা আবর্তিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক এন্টিবডি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে তা। এটা একটা পারমাণবিক চুল্লির মতো। এতে রয়েছে চেইন রিঅ্যাকশন এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ব্রাজিলের একজন চিকিৎসক মাগুয়েল নিকোলেলিস। নাভেকা বলেছেন, আমরা ব্রাজিলে এবং অন্য দেশগুলোতে এই ভাইরাসের বিস্তার বন্ধে পড়িমড়ি করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

ব্রাজিলের এই সংকট এখন সীমান্তের বাইরেও অনুভূত হচ্ছে। প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন (পিএএইচও) রিপোর্ট করেছে যে, পি১ ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। এক সময় লাতিন আমেরিকায় কোভিড পোস্টার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন ছিল উরুগুয়ে। কিন্তু এখন তারাও মৃতের মিছিল সামাল দিতে ব্যস্ত। সেখানে সরকারি তথ্যমতে, এপ্রিলে করোনায় মারা গেছেন ১২১ জন। গত বছরে মোট মৃতের চেয়ে এই সংখ্যা বেশি। আর্জেন্টিনার ভাইরাস বিশারদ হামবার্তো দেবাত বলেছেন, কিভাবে সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে খারাপের দিকে যেতে পারে তার একটি ভাল উদাহরণ হলো উরুগুয়ে। পি১ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, কলম্বিয়া, পেরু, চিলি, কানাডা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ফলে তেমন কোন ফল আসবে না। কারণ, এরই মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। ডেবাত বলেন, পি১ কে দূরে রাখার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনায় ৭০ বছরের ওপরে বয়স এমন শতকরা মাত্র ৪০ ভাগ মানুষ করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। এখনও সেখানে সবকিছু বিলম্বিতভাবে চলছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার আগে আমাদেরকে আর কত প্রাণ হারাতে হবে?

আরো সংবাদ