আজ - শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি, (বর্ষাকাল), সময় - সকাল ১০:২৬

   পৃথিবীর কোন দেশে মহাসড়কের পাশে এমন বড় বড় গাছ আছে? : সাজেদ রহমান।

সাজেদ রহমান:যশোর-বেনাপোল সড়কের গাছ কাটা নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে অনেকে ফেসবুকে ঝড় তুলেছেন। যাঁরা ঝড় তুলেছেন এঁদের অনেকে পন্ডিত ব্যক্তি এবং আমি তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে চিনি।তাঁরা বলছেন, পৃথিবীতে এতো গাছ কেটে রাস্তা সম্প্রসারণের নজির নেই।কিন্তু তাঁরা একটা কথা চেপে যাচ্ছেন, তা হলো, পৃথিবীর কোন দেশে মহাসড়কের পাশে এমন বড় বড় গাছ আছে? তাঁরা অনেকে ভারতের উদাহরণ দিচ্ছেন, বলছেন, বেনাপোলের ওপারে(পেট্রাপোল) তারা গাছ রেখে ৪ লেন করেছে। কিন্তু তাঁরা জানেন না, ভারত সরকার ৮ বছর আগে মাত্র ২০০ মিটার সড়ক গাছ রেখে ৪ লেন করার পর স্থানীয়রা তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, যশোরের বকচরের জমিদার কালী পোদ্দারের মা গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু কালী পোদ্দার কৃপণ জমিদার। এ কারণে বজরার মাঝি কালীর মাকে বজরায় উঠতে দেয়নি। মাঝি বলেছে, ‘তোমাকে নিলে কড়ি পাওয়া যাবে না।’ মা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এ কথা কালী পোদ্দারকে জানান। কালী আবেগতাড়িত হন। তিনি মা গঙ্গাস্নানে যাবেন এ জন্য সড়ক নির্মাণের ব্রত গ্রহণ করেন। ১৮৪০ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন।(এই সড়কটি ভারতের যশোর-বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-চাকদহ, পাশাপাশি বনগাঁ-হাবড়া-বারাসাত পর্যন্ত গাছ ছিল, ইতোমধ্যে বনগাঁ থেকে চাকদাহ পর্যন্ত কয়েক হাজার গাছ কেটে তারা রাস্তা প্রশস্ত করেছে।) হাজার হাজার শ্রমিক রাত-দিন কাজ করে ১৮৪২ সালে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করেন। সে সময় সড়ক নির্মাণে দুই লাখ ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয় হয়েছিল। এরপর মা ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গাস্নানে যাবেন এ জন্য রাস্তার দুই ধারে কালীবাবু বিদেশ থেকে এনে অতিবর্ধনশীল রেইন্ট্রি বৃক্ষের চারা রোপণ করেন। সেই বৃক্ষগুলো যশোর-বেনাপোল রোডকে এখনো ছায়া দিচ্ছে। যশোর থেকে কলকাতা কালীবাবুর এই রাস্তার নাম ‘যশোর রোড’।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল, যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো ‘যশোর রোড’। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।
এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টম্বর অন যশোর রোড়’। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ।এই কারণে সড়কটি মুলত ঐতিহাসিক। কিন্তু যারা গাছ কাটার বিপক্ষে, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, যশোরের অধিকাংশ মানুষ উন্নয়নের স্বার্থে গাছ কাটার পক্ষে। যখন ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড় ৪ লেন হয়েছিল, তখন সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা হয়েছিল, তখন কোথায় ছিলেন আপনারা। তখন তো কাটা হয়েছিল কয়েক হাজার গাছ। ঢাকা-চট্রগ্রাম ৪ লেন হলো তখনও কয়েক হাজার গাছ কাটা পড়েছে, তখন কোথায় ছিলেন পন্ডিতরা। একজন তো দেখলাম, যশোর রোডের গাছ গুলোকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। তার নামটা এখানে উল্লেখ করলাম না। অথচ তার মা’কে সে ভাত দেয় না। আর একজন গাছ নিয়ে মায়া কান্না করছে, তাকে চিনি, সে বান্দরবনের সংরক্ষিত বন থেকে কাঠ নিয়ে এসে ঢাকার বাসার ফার্নিচার তৈরি করেছে।
আমার কথা হলো, যশোর রোডের গাছ কেটে ৪ লেন হোক, তবে সরকারকে রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে হবে। যে গাছ সড়কের ক্ষতি করবে না। দুর্ঘটনা ঘটবে না সড়কে। আমি মনে করি আমার কথার সাথে সবাই একমত। এছাড়া সরকার যশোর বেনাপোল সড়কের পাশে (ঝিকরগাছা ও সদর) দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। সেখানে মোট ৯শ একর জমি অধিগ্রহন করা হবে। আর গাছ রেখে যশোর বেনাপোল সড়ক ৪ লেন করতে গেলে ৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহন করতে হবে। এতে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অনেকের বসত ঘর ভাঙতে হবে। এ বিষয়টিও তো ভেবে দেখতে হবে।

জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিবেদক সাজেদ রহমানের ফেসবুক সময়রেখা থেকে….

আরো সংবাদ