আজ - শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি, (বর্ষাকাল), সময় - দুপুর ১:১১

ফরিদপুরের এসপির অবৈধ ৮ কোটি টাকা

► দুদকের মামলা এসপি সুভাষ চন্দ্র সাহাকে প্রত্যাহার
► মোহাম্মদপুরে বহুতল বাড়ির বিষয়েও তদন্ত হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক :

 

দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা এবং এই অর্থের উৎস, অবস্থান ও মালিকানা গোপন রাখার অভিযোগে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তাঁর স্ত্রী রিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বংশাল থানায় মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ। এ মামলা হওয়ার আগের দিন সোমবার সুভাষ চন্দ্র সাহাকে ফরিদপুর থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় চার মাস আগে সুভাষ ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ নামে ওয়ান ব্যাংকের তিনটি শাখায় ১৯টি এফডিআরের আট কোটি ৩৬ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৭ টাকার সন্ধান পায় দুদক। তাঁদের সর্বশেষ আয়কর বিবরণীতে ওই টাকার কোনো উল্লেখ নেই। এরপর ব্যাংক হিসাব জব্দ রেখে তদন্ত করে দুদক নিশ্চিত হয়, ওই অবৈধ টাকা গোপনে ব্যাংকে রেখেছেন এসপি সুভাষ সাহা।

সূত্র মতে, কর্মরত প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় সুভাষ চন্দ্র সাহার বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে তাঁর একটি বহুতল বাড়ি আছে বলেও তথ্য পায় দুদক। এ বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। টাকার ব্যাপারে প্রমাণপত্র জোরালো হওয়ায় মামলা থেকে রেহাই পাননি সুভাষ। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের বিভাগীয় তদন্তের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের বলেন, ওই অর্থ অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত জানা সত্ত্বেও এসপি নিজের এবং স্ত্রী রীনা চৌধুরীর নামে ওয়ান ব্যাংকের তিন শাখায় এফডিআর হিসাবে জমা রেখে ভোগদখলে রেখেছেন। আসামি রীনা চৌধুরী স্বামীর অর্থ অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত জেনেও যৌথ নামে এফডিআর হিসাবে জমা রেখে এবং তা গোপন করে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় মামলা করা হয়েছে বলে তিনি জানান। ঢাকার বংশাল থানার ওসি শাহিদুর রহমান জানান, দুদকের ঢাকার সহকারী পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে মামলাটি করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সুভাষ চন্দ্র সাহা পুলিশ বিভাগে চাকরিকালে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে তাঁর নিজ নামে এবং স্ত্রী রীনা চৌধুরীর নামে একাধিক এফডিআর হিসাব খোলেন। তাঁরা যৌথ নামে ওয়ান ব্যাংকের ঢাকার বংশাল শাখায় ছয়টি, এলিফ্যান্ট রোড শাখায় একটি এবং যশোর শাখায় ১২টি এফডিআর হিসাবে অর্থ জমা করেন। তাঁদের ১৯টি এফডিআর হিসাবে বর্তমানে মোট স্থিতির পরিমাণ আট কোটি ৩৬ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৭ টাকা। এর মধ্যে ওয়ান ব্যাংক বংশাল শাখায় ছয়টি এফডিআরে সুদসহ মোট দুই কোটি ৫১ লাখ ১৪ হাজার ৪৬৭ টাকা, এলিফ্যান্ট রোড শাখায় একটি এফডিআরে ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৪২ টাকা এবং যশোর শাখায় ১২টি এফডিআরে পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৮৫৮ টাকা রয়েছে ওই দম্পতির নামে।

এজাহারে বলা হয়, ‘এসপি সুভাষ চন্দ্র সাহা পুলিশ বিভাগে চাকরি করা অবস্থায় বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই টাকা উপার্জন করেছেন। এই অর্থের উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন রেখে আসামি সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তাঁর স্ত্রী রীনা চৌধুরী মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।’

এজাহারে আরো বলা হয়েছে, তাঁদের যৌথ নামীয় এফডিআরগুলোর স্থিতি এবং তা অর্জনের উেসর বিষয়টি ২০১৬-১৭ করবর্ষ পর্যন্ত দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ করবর্ষে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পর খোলা এফডিআর হিসাবে জমাকৃত অর্থের সমপরিমাণ টাকা ২০১৬-১৭ করবর্ষে তাঁদের দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নে উদ্বৃত্ত ছিল না। অর্থাৎ তিনি পুলিশ বিভাগে চাকরিকালে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত এই অর্থের উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করেছেন। আর তাঁর স্ত্রী রীনা চৌধুরী স্বামীর অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থ জেনেও স্বামীর সঙ্গে যৌথ নামে এফডিআর হিসাবে জমা রেখে এবং তা গোপন করে ওই অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন।

জানা যায়, গত ১৫ জুন দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ান ব্যাংকের ঢাকার ওই দুই শাখার এফডিআরগুলো জব্দ রাখার আদেশ দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ। একই দিন ওয়ান ব্যাংকের যশোর শাখার এফডিআর হিসাবগুলো জব্দ রাখার আদেশ দেন যশোর সিনিয়র দায়রা জজ আদালত।

দুদক ও পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুন মাসেই এসপি সুভাষের অবৈধ অর্থের সন্ধান পায় দুদক। ২০১৩ সালের ২৬ মে থেকে ২০১৭ সালের ২২ মে পর্যন্ত সময়ের হিসাব অনুসন্ধান করে দুদক ওই তথ্য পায়। একই সময়ে দুদক অভিযোগ পায়, এসপি সুভাষ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ৩০/১০-বি নম্বর বাড়িটির মালিক হয়েছেন অবৈধভাবে। সুভাষ, তাঁর স্ত্রী রীনা এবং দুই ছেলে রাহুল সাহা ও সৌমিত্র সাহার ব্যাপারে তদন্ত করে বাড়িটির মালিকানা যাচাই করতে গত ৩০ জুলাই ফরিদপুর জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় দুদক। বিষয়টি এখনো তদান্তাধীন বলে জানায় সূত্র।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সুভাষ চন্দ্র সাহা এসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঝালকাঠিতে যোগ দেওয়ার আগে কুষ্টিয়া ও যশোরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের নভেম্বরে ফরিদপুরে এসপি হিসেবে বদলি হন তিনি। সুভাষের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার রাধানগর গ্রামে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্নীতির মামলা হওয়ার কারণে এরই মধ্যে এসপি সুভাষের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে তাঁকে ফরিদপুর থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় আনা হয়েছে। এটা এক রকম ওএসডি বলা যায়। তদন্ত শেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বা গ্রেপ্তারও হতে পারেন।’

একটি সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ ওঠার পরও সুভাষ সাহা প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে তদবির করেন। এ কারণে দ্রুত মামলা করতে পারেনি দুদক। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যাচাই করে দেখে সুভাষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই সুযোগেই মামলা করে দুদক। বাড়িসহ অন্যান্য অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুভাষের বিরুদ্ধে আরো মামলা হতে পারে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুর রহমানের বরাত দিয়ে ফরিদপুর থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহাকে সোমবারই প্রত্যাহার করে ঢাকায় ফেরত নেওয়া হয়েছে

আরো সংবাদ