আজ - শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, (গ্রীষ্মকাল), সময় - রাত ২:১০

খুলনায় রেললাইনে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

রেলের শহর খুলনা। প্রায় ৫০ কিলোমিটার রেলপথ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সমগ্র মহানগরীজুড়ে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় রেললাইনের পাশ জুড়ে থাকা বিস্তীর্ণ জমি বেদখল হয়ে যায়। নির্মাণ করা হয় কাঁচা পাকা স্থাপনা। প্রায় প্রতিবছর অবৈধ দখলদারদের তালিকা করে রেল বিভাগ। উচ্ছেদ অভিযানের ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর অদৃশ্য মহলের ইশারায় অভিযানের উদ্যোগ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। রেললাইনের জায়গা দখল করে বস্তি তৈরি করা সবচেয়ে লাভজনক। তাই দখলদারেরা নগরীর অধিকাংশ রেলের জায়গাতে বস্তি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। এভাইে চলছে গত কয়েক দশক।
খুলনায় বস্তিগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা পরিবার পরিজনের সাথে চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। নগরীর ২৮টি পয়েন্টে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। কোনো রকমে ঝুঁপড়ি ঘর বানিয়ে থাকছে তারা। রেললাইন থেকে তাদের ঘরগুলোর গড়পরতা দূরত্ব ৮ থেকে ১০ ফুট। শুধু ঘর নয়, সরকারি জায়গাকে নিজের মনে করে এবং দখল পাকাপোক্ত করতে ঘরের সামনে বাড়তি জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তরি তরকারি চাষ ও হাঁস মুরগিও পুষছে তারা। সামান্য বৃষ্টি হলেই গোলপাতার ছাদ চুঁয়ে ঘরে পানি ঢোকে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বলে কোনো কিছু নেই। ছোট ছোট শিশুরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘরের সামনে খেলা করছে। রেললাইনের উপরই প্রায় সারাদিন তারা থাকে, ট্রেন এলে তাদের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ কেউ রেললাইনের পাশে জীবিকার জন্য মুদি দোকান দিয়েছে। খুলনার রেলস্টেশন থেকে ১০ জোড়া ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে। এ হিসাবে দিনে কমপক্ষে ২০ বার মৃত্যুঝুঁকি তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোনো কারণে যাত্রীবাহী বা মাল গাড়ি বস্তির আশেপাশে লাইনচ্যুত হলে ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। নগরীর জোড়াগেট, আলমনগর, কদমতলা, বৈকালী, দৌলতপুর, রেলিগেট, ফুলবাড়িগেটসহ কমপক্ষে ২৮টি স্থানে রেললাইনের পাশে অবৈধভাবে বস্তি গড়ে উঠছে।
নগরীর আলমনগর এলাকার রেলবস্তিতে বসবাসকারী ইজিবাইক চালক আব্দুস সামাদ জানান, গত ৩ বছর ধরে এখানে তিনি পরিবার নিয়ে রয়েছেন। দুটি গোলপাতার ঘর তার। প্রতিমাসে রেলের একজন কর্মচারি এসে ১ হাজার টাকা নিয়ে যান। নগরীর জোড়াগেট এলাকার বস্তিতে বসবাসকারী হাজেরা বেগম পেশায় একজন তরকারি বিক্রেতা। ২ বছর ধরে একটি ঘর নিয়ে বস্তিতে রয়েছেন। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতিমাসে তাঁর কাছ থেকে ৫শ’ টাকা করে নেন। তার পাশে বড় দুটি ঘর নিয়ে থাকেন আজিজুল হক নামে একজন নির্মাণ শ্রমিক। তিনি প্রতিমাসে দেন ১২ শ’ টাকা। এই টাকাও নেন ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি। অনুসন্ধানে প্রভাবশালী সেই ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়ার পর তিনি জানান, মোট ৩৬টি ঘর আছে বস্তিতে। প্রতিমাসে ৪৫ হাজার টাকা ভাড়া ওঠে। রেলওয়ের কয়েকজনকে মাসিক টাকা দিতে হয়। এছাড়া পার্টির কিছু লোককে টাকা দিতে হয়।
সূত্র জানায়, ২০০২ সালে নগরীর ৪ ও ৫নং ঘাট এলাকায় রেলের জমিতে বস্তি তৈরি করেন তৎকালীন বিএনপি নেতারা। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলটির স্থানীয় নেতারা বস্তির দখল নেন। এ বস্তিটি রাজনৈতিক দলের ভোটের ডিপো। বস্তিবাসীদের ভোটের জন্য এলাকার কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিরা দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। নগরীতে যতগুলো স্থানে রেলের জায়গা দখল করে বস্তি তৈরি করা হয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছেন রেলের অসাধু কর্মচারি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাই এ সকল বস্তি উচ্ছেদের কোনো উদ্যোগ সফল হয় না।
খুলনা রেলের ভ‚-সম্পত্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা রেলের মোট জমির পরিমাণ ১৯৫ দশমিক ৪৪ একর। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ১০ একর, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৬ দশমিক ৪২ একর, খুলনা জেলা প্রশাসন ২ দশমিক ৮৭ একর, মৎস্য লাইনসের ১৩ দশমিক ৮৭ একরসহ মোট ৩৩ দশমিক ৫ একর জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ১৬২ দশমিক ৩৯ একর জমি রেলওয়ের অপারেশন এলাকা। ওই এলাকার প্রায় ৬০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে।
সিটি কর্পোরেশনের চীফ প্লানিং অফিসার আবির-উল-জব্বার বলেন, নগরীর বস্তিগুলোর ঘিঞ্জিপূর্ণ পরিবেশে লোকজন অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বস্তিবাসীদের জীবন-মান উন্নয়নে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। সিটি করপোরেশন বিকল্প থাকার ব্যবস্থা না করে বস্তি উচ্ছেদ করতে পারে না। তাই অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ কিছুটা সময় সাপেক্ষ বিষয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে খুলনা ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা কার্যালয়ের কাচারী ১৮ এর ফিল্ড কানুনগো মো. মনোয়ারুল ইসলাম জানান, অচিরেই দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোপূর্বে একাধিক অভিযান পরিচালনা করে রেলের বিশাল জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে।

আরো সংবাদ