আজ - বুধবার, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সন্ধ্যা ৭:৪৩

সম্রাটের সাম্রাজ্যে একদিন!

যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত নেতা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঘটনাবহুল একটি দিন। ভোররাতে আটক, দুপুরে কাকরাইল কার্যালয়, এরপর রাজধানীতে দু’টি ফ্ল্যাটে তল্লাশি-অভিযানের মধ্যেই কাটলো সম্রাটের সাম্রাজ্যে সারাদিন। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর চাঞ্চল্যকর নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে দিনটি।

রোববার (৬ অক্টোবর) ভোরে দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে ভারত সীমান্তবর্তী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাওয়া সম্রাটকে সহযোগী আরমানসহ আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব)। তখন থেকেই গণমাধ্যমকর্মীরা অপেক্ষায় ছিলেন সম্রাটকে কখন ঢাকায় আনা হবে।

কড়া নিরাপত্তায় সম্রাটের অফিসে র‌্যাবের অভিযান। ছবি: শাকিল আহমেদ

সম্রাটকে নিয়ে তালা ভেঙে তার কার্যালয়ে র‌্যাব
এদিন দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলের ভূইয়া ম্যানশনে সম্রাটকে নিয়ে প্রবেশ করে র‌্যাব-১’র শীর্ষ পর্যায়ের একটি দল। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের উপস্থিতিতে তালা ভেঙে ভবনটিতে প্রবেশ করেন তারা। অভিযান ও তল্লাশিতে এতটাই কড়াকড়ি ছিল যে, ভবনটির অবস্থান রমনা থানা ও র‌্যাব-৩’র আওতাধীন এলাকায় হলেও তল্লাশির সময় ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি তাদের কোনো সদস্যও।

সম্রাটের দুই ফ্ল্যাটে অভিযান
সম্রাটকে নিয়ে তার কার্যালয়ে যখন অভিযান চলছে, তখন রাজধানীর আরও দু’টি জায়গার দুই ফ্ল্যাটে একযোগে অভিযান চালায় র‌্যাব। দুপুর ৩টার দিকে তল্লাশি চালাতে সম্রাটের শান্তিনগরের ফ্ল্যাটে যান র‌্যাব সদস্যরা। প্রায় একই সময়ে মহাখালীতেও তার আরেকটি বাসায় চলে অভিযান

সম্রাটের বেডরুমে পাওয়া গেছে লোড করা পিস্তল। ছবি: শাকিল আহমেদ


 
সম্রাটের কার্যালয় থেকে পিস্তল-গুলি-টর্চার মেশিন উদ্ধার
দুই ফ্ল্যাট থেকে কিছু পাওয়া না গেলেও অনেক কিছু মিলেছে ক্যাসিনো সম্রাটের সাম্রাজ্য বলে পরিচিত কাকরাইলের ভূইয়া ম্যানশনে। ১১৬০ পিস ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, অস্ট্রেলিয়ান দু’টি ক্যাঙ্গারুর চামড়া ও পাঁচ রাউন্ড গুলিভর্তি ম্যাগজিনসহ ৭.৬৫ মিলিমিটার বোরের একটি চাইনিজ পিস্তল। চতুর্থ তলায় সম্রাটের একটি আলিশান বেডরুমের বিছানায় তোশকের নিচে পিস্তলটি পাওয়া যায়। 

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পিস্তলটি শুধু লোড করাই নয়, বরং ‘রেডি টু ফায়ার’ অবস্থায় ছিল। অর্থ্যাৎ, লোডের পর চেম্বার টেনে সেখানে গুলি ভরা ছিল। ট্রিগার টিপলেই গুলি বের হতো।

একই সময় নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত হতো এমন দু’টি ‘ইলেকট্রিক শক মেশিন’ ও লাঠিও পাওয়া যায় তল্লাশিতে।

পাওয়া গেছে বিদেশি মদ ও ইয়াবা। ছবি: শাকিল আহমেদ

বিলাসী জীবন
ভবনটির চতুর্থ ও সপ্তম তলায় রীতিমতো ফাইভ স্টার হোটেলের মতো সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন সম্রাট। আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার সেই পাকা ধানে র‌্যাব মই দেওয়ায় গণমাধ্যমকর্মীরাও দেখতে পান সেই শান-শওকত। বিশাল অফিস কামরা, আধুনিক আসবাবে সুসজ্জিত তিনটি বেডরুম রয়েছে ফ্লোরগুলোতে।

তবে, সবকিছু ছাপিয়ে যায় নবম তলার ছাদে সম্রাটের বানানো প্রাসাদ ও বাগানবাড়ি। এই ফ্লোরে আসার অনুমতি শুধু সম্রাট ও তার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে থাকার কারণটিও বেশ পরিষ্কার। গাছ-গাছড়া, কৃত্রিম ঝর্ণা– রুচিশীলতার এই নিদর্শনটুকু পেরিয়ে বাগানবাড়িতে ঢুকলেই চোখ ছানাবড়া হবে যেকোনো সাধারণ মানুষের। বলিউড সিনেমায় দেখা ড্যান্স বারের দেখা মিলবে চোখের সামনেই! জানা যায়, মুষ্টিমেয় খুবই কাছের কিছু মানুষদের মনোরঞ্জনের জন্য সংরক্ষিত ছিল এই ফ্লোর।

সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। ছবি: শাকিল আহমেদ

অধিকতর তদন্ত করবে র‌্যাব
বিদেশি বন্যপ্রাণীর চামড়া অবৈধভাবে রাখার অপরাধে সম্রাটকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। মাদক, অস্ত্র ও মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পেলে আলাদা মামলা হবে বলেও জানান এই ম্যাজিস্ট্রেট। তবে, ক্যাসিনো ইস্যুসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব অধিকতর তদন্ত শেষে পাওয়া যাবে বলে জানান র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সরোয়ার বিন কাশেম। এর জন্য আদালতে সম্রাটকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সম্রাটের কীর্তিকলাপ ফাঁস করেছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। ছবি: শাকিল আহমেদ

স্ত্রীর মুখে গুমর ফাঁস
সম্রাটের কীর্তিকলাপের গুমর ফাঁস ও জুয়া আসক্তির কথা মিডিয়ার সামনে অকপটে স্বীকার করেছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে জানেন না দাবি করলেও স্ত্রী জানান, রাজনৈতিক কর্মীদের খরচ জোগাতেই এসব করে থাকতে পারেন তার স্বামী। সম্পত্তি, ফ্ল্যাট বা অন্যকিছুর প্রতি লোভ না থাকলেও জুয়া খেলার প্রতি সম্রাটের প্রবল আসক্তি ছিল বলে জানান তিনি।

যুবলীগ থেকে বহিষ্কার
সময় খারাপ থাকলে বিপদ চারদিক থেকেই আসে। সময়টা এমনই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের। একদিকে র‌্যাবের জেরায় জেরবার, তার মধ্যেই খবর আসে যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন তিনি।

ক্যাসিনো পরিচালনাসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত থাকার ঘটনায় র‌্যাবের হাতে আটকের পরপরই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান আলীকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ।

সম্রাটকে বের করার সময় হৈ-হুল্লোড় শুরু করে সমর্থকরা। ছবি: শাকিল আহমেদ

সমর্থকদের হৈ-হুল্লোড়
সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে ভূইয়া ম্যানশন থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় সম্রাটকে। এসময় র‌্যাব ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই সম্রাটের পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায় শতাধিক যুবলীগ নেতাকর্মীদের। ‘সম্রাট তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’- এমন স্লোগান দিলেও পুলিশের চার্জে কিছু সময়ের মধ্যেই অবশ্য সড়ক ছেড়ে যেতে হয় তাদের। জানা যায়, সম্রাটকে গাড়িতে তোলার সময় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তিন যুবককে আটক করে রমনা থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে, তাদের বিরুদ্ধে ১৫১ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। 

সম্রাটের ঠাঁই কেরানীগঞ্জ কারাগারে
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া সাবেক যুবলীগ নেতাকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে। 

এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় সম্রাটের সাম্রাজ্যে গোটা একটা দিন। 

আরো সংবাদ