যশোরে দিনদুপুরে বোমা ফাটিয়ে ১৭ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। যশোরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত প্রায় আড়াই লাখ টাকা লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লুণ্ঠিত টাকার ব্যাগ, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ও দুটি চাকু উদ্ধার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্যা জানান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সভাকে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ডাকাতদের হামলায় গুরুতর জখম এনামুল হক মণিহার এলাকার ফলপট্টির একজন প্রতিষ্ঠিত ফল ব্যবসায়ী। তার আড়তে লেবারের কাজ করে টিপু নামে এক যুবক। দৈনিক ২শ’ টাকা মজুরি পায় সে। ব্যবসায়ী এনামুল হক বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে লেনদেন করতেন। এ বিষয়টি টিপুর নজরে পড়ে যায়। তার এই টাকা ছিনতাইয়ের স্বপ্ন ছিল দীর্ঘদিনের। এক পর্যায়ে সে জামাই রাজ্জাক নামে পরিচিত একজন ফল ব্যবসায়ীকে তার পরিকল্পনার কথা জানায়। জামাই রাজ্জাকের আসল বাড়ি পিরোজপুরে। বিয়ে করে যশোরে বসবাস করায় সে এলাকায় জামাই রাজ্জাক নামে পরিচিত। সে হত্যাসহ বহু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। টিপুর পরিকল্পনায় সায় দিয়ে ব্যবসায়ী এনামুল হকের টাকা লুট করার জন্য দুর্বৃত্তদের জড়ো করে। মূলত এনামুল হক যাদের চিনতে না পারেন এমন আপরাধিদের ডাকাতির মিশনে পাঠানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন টিপু জেস টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেয় তার সঙ্গীদের এনামুল হককে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। সঙ্গী দুর্বৃত্তদের সাথে এ জন্য টিপু মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। টাকা লুটের জন্য ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের আশেপাশে আগে থেকেই দুর্বৃত্তরা অবস্থান নিয়েছিল। কয়েকটি মোটরসাইকেল চলে যাওয়ার পর এনামুল হকের মোটরসাইকেল ব্যাংকের সামনে এসে দাঁড়ালে টিপু এ সময় সঙ্গীদের সংকেত দিয়ে চিনিয়ে দেয়। এর পরপরই ডাকাতরা বোমা ফাটিয়ে ছুরিকাঘাতে তার কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর ডিবি পুলিশ ও কোতয়ালি থানা পুলিশের একাধিক টিম ডাকাতদের আটক ও লুণ্ঠিত টাকা উদ্ধারে জোরালো অভিযান শুরু করে। বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ডাকাতদের শনাক্ত করা হয়।
এরপর যশোরের ধর্মতলা, বসুন্দিয়া, বারান্দী মোল্লাপাড়া, সিটি কলেজপাড়ার ব্যাটারিপট্টি, পুলিশ লাইন টালিখোলা ও বাঘারপাড়ার আলাদিপুরে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত টিপুসহ ৫ জনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে এ সময় লুণ্ঠিত ২ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা ও ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল (যশোর-ল-১৩-২৬৩৩), দুটি চাকু ও মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, টাকা লুটের মিশনের সাথে ৮-১০ জন দুর্বৃত্ত জড়িত। এদের আবার গডফাদারও রয়েছে। এই গডফাদারদের ছত্রছায়ায় থেকে দুর্বৃত্তরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জানান, গডফাদারদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। তিনি জানান, টিপু ও শুভ নামে আটক আরেক দুর্বৃত্তের কাছ থেকে তাদের ভাগে পাওয়া ওই টাকা উদ্ধার করা হয়। ডাকাতির সাথে জড়িত আটক ৫ দুর্বৃত্ত হচ্ছে-শহরের পুলিশ লাইন টালিখোলা এলাকার জনৈক শফি দারোগার বাড়ির ভাড়াটিয়া মুনসুর মোল্যার ছেলে টিপু (২৪), বারান্দী মোল্লাপাড়া কবরস্থানের পাশের রবিউল ইসলামের ছেলে সাঈদ ইসলাম শুভ (২৪), ধর্মতলা হ্যাচারিপাড়ার রুহুল আমিনের ছেলে বিল্লাল হোসেন ওরফে ভাগ্নে বিল্লাল (২২), সিটি কলেজপাড়ার ব্যাটারিপট্টির নিজাম উদ্দিনের ছেলে রায়হান (২৮) ও বারান্দীপাড়া মালোপাড়ার মৃত মুফতি আলী হুসাইনের ছেলে ইমদাদুল হক (২১)।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সালাউদ্দিন শিকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক-সার্কেল গোলাম রব্বানী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপু সরোয়ার, কোতয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান ও ডিবি পুলিশের ওসি সোমেন দাশ উপস্থিত ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, জামাই রাজ্জাক যশোরে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে শহরের বারান্দী মোল্লাপাড়া কবরস্থান এলাকায় বসবাস করে। শহরের গাড়িখানা রোডের পেট্রোল পাম্পের সামনে সে ফলের ব্যবসা করে। টিপু তাকে টাকা লুটের পরিকল্পনার কথা জানালে সে তার পরিচিত দুর্বৃত্তদের দিয়ে ‘কাজটি’ করে দিবে বলে জানায়। কিন্তু টিপুকে টাকা লুটের মিশনটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। সূত্র জানায়, আটক রায়হান তার মোটরসাইকেলে অন্য দুর্বৃত্তদের আনা নেওয়ার কাজের দায়িত্বে ছিল। আর টিপুর দায়িত্ব ছিল জেস টাওয়ারের সামনে অবস্থান নিয়ে এনামুল হককে চিনিয়ে দেওয়ার। সূত্র জানায়, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে টাকা লুটের পর ব্যাগ নিয়ে যাদের পালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে তারা হল পূর্ব বারান্দীপাড়া টাওয়ারের মোড় এলাকার মেহেরুন নেছার ছেলে আরাফাত, তার ফুফাতোভাই ধর্মতলার সোহেল ও বারান্দী মোল্লাপাড়া কবরস্থান এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে শুভ। টাকার ব্যাগ আরাফাতের কাছে ছিল এবং ছবিতে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে দেখা প্রথমজন সোহেল ও দ্বিতীয় দুর্বৃত্ত শুভ। এই ৩ জনের মধ্যে শুভ ধরা পড়েছে।
সূত্রটি জানায়, আরাফাত পূর্ব বারান্দীপাড়া টাওয়ারের মোড় এলাকায় মায়ের সাথে বসবাস করলেও তার আসল বাড়ি ধর্মতলায়। তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। টাকা লুটের পর আরাফাত প্রথমে পূর্ব বারান্দীপাড়া টাওয়ারের মোড় এলাকায় বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের কাছে ৭ লাখ টাকা রেখে দেয়। এরপর সে টাকার ব্যাগ নিয়ে পূর্ব বারান্দীপাড়া খালপাড়ে তার বন্ধু কালুর বাড়িতে যায়। সেখানে শুভ ও সোহেলও আসে। কিন্তু কালু টাকা লুটের বিষয়ে কিছু¦ই জানতোনা। আরাফাত তার বাড়িতে গিয়ে ব্যাগ খুলে গুনে সকলে জানায়, ১০ লাখ টাকা রয়েছে। এরপর তারা টাকা ভাগবাটোয়ারা করে। শুভ ১ লাখ, টিপু ১ লাখ টাকা, জামাই রাজ্জাক ১ লাখ টাকা ও রায়হান ভাগ পায় ২০ হাজার টাকা। বাকি টাকা জামাই রাজ্জাক নিজের কাছে রেখে দেয় গডফাদারসহ অন্যদের দেওয়ার জন্য। সূত্র জানায়, পুলিশি অভিযানে শুভকে বসুন্দিয়া থেকে, ভাগ্নে বিল্লালকে ধর্মতলা থেকে, টিপু ও রায়হানকে বিমান অফিস মোড় এলাকা থেকে এবং ইমদাদুল হককে পূর্ব বারান্দীপাড়া মালোপাড়ায় তার বাড়ি থেকে আটক করা হয়। ডাকাতির সময় বিস্ফোরিত বোমাটি ইমদাদুল হক সরবরাহ করেছিল। আটক শুভ’র কাছ থেকে ৮৮ হাজার ৫শ’ টাকা, টিপুর কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা, রায়হানের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বারান্দী মোল্লাপাড়া কবরস্থান এলাকায় জামাই রাজ্জাকের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে বাড়িতে জামাই রাজ্জাক ও তার স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, টাকার ব্যাগ ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি চাকু কালুর বাড়ির কলপাড় থেকে উদ্ধার করা হয়। ডাকাতির সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় কালু ছাড়াও তার দুই ভাইকে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। তার এক ভাইয়ের নাম বিল্লাল। তবে অপর ভাইয়ের নাম জানা যায়নি। অপর একটি সূত্র জানায়, একই অপরাধী চক্র ঘটনার ১০-১২দিন আগে আর এন রোডের এক ব্যবসায়ীর টাকা লুটের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সেই মিশনে সফল হতে পারেনি। সূত্র জানায়, সম্প্রতি ধর্মতলা কাঁচাবাজার এলাকায় বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। এর সাথে শুভ ও সোহেল সরাসরি জড়িত ছিল। ১৭ লাখ টাকা ডাকাতির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইনসপেক্টর তুষার কুমার মণ্ডল জানান, আটক ৫ জনকে বুধবার আদালতে সোপর্দ করা হয়। এর মধ্যে শুভ ও টিপু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. সাইফুদ্দীন হোসাইন তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। পরে আদালত আটক ৫ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।