আজ - শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - সন্ধ্যা ৭:১৭

৮১১টি নম্বর স্পুফিং করে চাঁদাবাজি

আড়াই বছরে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর নকল করে প্রতারণা * ফাঁদে পড়ে মোহাম্মদপুরের তিন কাউন্সিলর প্রার্থীর ১৭ লাখ খোয়া * সন্দেহভাজন ফোনে ফিরতি কলে যাচাইয়ের পরামর্শ পিবিআই প্রধানের

ফরহাদ হাসান :: হ্যালো, আমি ওসি বলছি। আপনি কি নির্বাচনে জিততে চান। আমি সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি আপনার এলাকায় দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের নম্বর দিচ্ছি, ওনার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। এরপর আরেকটি নম্বর থেকে ফোন আসে। নিজেকে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে ভোটে জিতিয়ে দেয়ার নামে চাওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। শুধু ওসি নন, কখনও এসপি, কখনও ডিসি, কখনও বিভিন্ন দফতরের প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে নানা অজুহাতে টাকা চাওয়া হয়। দেখানো হয় ভয়ভীতি। এগুলো ওইসব কর্মকর্তার প্রকৃত ফোন নম্বর নয়। প্রতারক চক্র মোবাইল নম্বর স্পুফিং করে বিভিন্ন ধরনের লোকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। চক্রটি মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আড়াই বছর ধরে তারা ৮১১ জন পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তার নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণা করে আসছে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রটি এ সময়ের মধ্যে মানুষের পকেট থেকে কয়েক কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। প্রসঙ্গত, কল স্পুফিং হল প্রকৃত নম্বর গোপন রেখে অন্য এক ব্যবহারকারীর নম্বর, অথবা বিশেষ কোনো নম্বর দিয়ে কল করার প্রযুক্তি।

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোহাম্মদপুর এলাকার তিন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছ থেকে মোহাম্মদপুর থানার ওসি ও আদাবর থানার ওসির মোবাইল নম্বর স্পুফিং করে নেয়া হয়েছে মোট ১৭ লাখ টাকা। পরে তারা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ পলাশ ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম বিপ্লব নামে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা পুলিশকে জানিয়েছে, তারা মূলত বিভিন্ন নির্বাচন ও উপনির্বাচনকে টার্গেট করে এ ধরনের প্রতারণা করে থাকে। যাকে টার্গেট করে, তার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা তুলে নেয়।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি পরিচয়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোহাম্মদপুর এলাকার বহুল আলোচিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। এ টাকা দিলে তাকে নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়া হবে। কিছুক্ষণ পরে ফোন আসে এক ম্যাজিস্ট্রেটের নম্বর থেকে। বলা হয়, বিকাশে টাকা না পাঠালে অন্য প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তারা। একইভাবে আদাবর থানার ওসির নম্বর স্পুফিং করে ফোন করা হয় আদাবর এলাকার প্রার্থীর সঙ্গেও। বিকাশে তার কাছ থেকেও নেয়া হয় ৫ লাখ টাকা। এছাড়া আরেক প্রার্থীর কাছ থেকে একই কায়দায় নেয়া হয় ৭ লাখ টাকা। মোট ১৭ লাখ টাকা খুইয়ে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তারা। এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় ৩টি মামলা করা হয়। প্রতারকদের ধরতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মাঠে নামে পুলিশ। পরে ৮ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগ এলাকা থেকে এ দুইজনকে গ্রেফতার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।

তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল যুগান্তরকে বলেন, সাইদুল ইসলাম বিপ্লব এই চক্রের মূলহোতা। তার কাছ থেকে ২৯টি বিকাশ সিম (যার প্রত্যেকটিতে বিকাশ অ্যাকাউন্ট করা), ৪টি মোবাইল ফোন, একটি পাসপোর্ট, নগদ ৪০ হাজার টাকা, ১২শ’ ইউএস ডলার, একটি এটিএম ডেবিট কার্ড ও ব্র্যাক ব্যাংকের একটি জমার স্লিপ উদ্ধার করা হয়েছে। বিকাশ নম্বরগুলো প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলো থেকে ৩৭ লাখ টাকা ক্যাশ আউট করা হয়েছে। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে কত টাকা ট্রানজেকশন হয়েছে, তা জানতে ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

তিনি জানান, পলাশ আইটিতে অভিজ্ঞ। সে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করত। পল্লবীতে একটি মেসে থাকার সময় পলাশের সঙ্গে সাইদুল ইসলাম বিপ্লবের পরিচয় হয়। এরপর থেকে অল্প পরিশ্রমে অর্থবিত্তের মালিক হতে ওরা এ ধরনের প্রতারণায় নামে।

তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, তারা ওসিদের নম্বর স্পুফিং করে এই প্রতারণা করেছে। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানার ওসির সরকারি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। তিনি জানান, এরা সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার ইনানি সাইটে নিবন্ধিত হয়ে আইটেল ডায়ালার অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণা করত। তিনি বলেন, এ সার্ভারে একটি নম্বর একবারই স্পুফিং করা যায়। এজন্য নির্দিষ্ট হারে ডলার খরচ করতে হয়। যে ৮১১টি নম্বর আমরা পেয়েছি, তা দিয়ে আলাদা আলাদা ৮১১টি অ্যাকাউন্ট খুলেছে তারা। এসব নম্বরে কী ধরনের প্রতারণা করেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এরই মধ্যে এরা কোটি কোটি টাকা নিয়েছে মানুষের কাছ থেকে। চক্রের মূল হোতা সাইদুল ইসলাম বিপ্লবের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের গোসাইঘাট থানায়, টাঙ্গাইলের সখীপুর থানায় মামলা রয়েছে। এছাড়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে দুটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা মুলতবি রয়েছে।

এরা ছাড়াও দেশে এ ধরনের একাধিক চক্র সক্রিয়। গত বছরের এপ্রিলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ওসির নম্বর ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগে একটি চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া একই বছর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি তদন্ত পরিচয়ে একটি চক্র চাঁদাবাজি করছিল। এ ধরনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে অহরহ ঘটছে। শুধু পুলিশ কর্মকর্তাই নন, মন্ত্রী, এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণার বেশকিছু ঘটনা ইতঃপূর্বে ধরা পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যে কারও মোবাইল ফোন নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণার কৌশল কয়েক বছর আগেই রপ্ত করেছে অপরাধীরা। বিশেষ সফটওয়্যার ও অ্যাপসের মাধ্যমে মোবাইল ফোন নম্বর স্পুফিং করছে। স্পুফিংয়ে প্রতারকচক্রের কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন আইডি (পরিচয়) গোপন রাখা যায়।

এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা নজরে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চক্রগুলোকে শনাক্ত করছে তারা। কিন্তু এরপরও চক্রের তৎপরতা থেমে নেই। তারা নতুন কৌশলে মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। এরপর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এটাই তাদের কাজ। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, টিএনও এবং বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ নম্বরের ‘ইয়েস কার্ড’ অ্যাপের মাধ্যমে কল স্পুফিং করে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর হুবহু নকল করে যে কাউকে ফোন করা যায়।

র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, প্রতারকরা গত দুই বছরে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আইজিপি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনের সিম স্পুফিং করেছে। চক্রটি তাদের নম্বর নকল করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, বদলি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ করেছে। অনুসন্ধানে এমন তথ্য পেয়ে মাঠে নামে পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দারা। এর আগেও বেশ কয়েকটি প্রতারকচক্র ধরা পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও স্পুফিং চক্র ধরা পড়েছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশেন-পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অস্বাভাবিক ফোন এলে কথা শেষ হওয়ার পর ওই নম্বরে কল করে যাচাই করতে হবে। কারণ স্পুফিংয়ের মাধ্যমে কল করা যাবে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই নম্বরে কলব্যাক করলে সেটি আসল ইউজারের কাছে চলে যাবে। তখন আসল ইউজারের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে সন্দেহ দূর হবে। তিনি বলেন, যে-ই এ ধরনের ফোন করুক না কেন, যাচাই করে নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ডিআইজি বলেন, এ ধরনের একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। নজরে এলেই তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাই এদের খপ্পর থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, মোবাইল ফোন স্পুফিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগগুলোর ব্যাপারে পুলিশ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করে থাকে। তবে এ ধরনের অপরাধীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমকে প্রলোভনে ফেলে, যা বেআইনি ও অনৈতিক। আর লোভে পড়ে ভিকটিম তাদের ফাঁদে পা দেন। তিনি বলেন, এ ধরনের লোভ সংবরণ করে নিজের কমনসেন্স ও নৈতিকতাকে কাজে লাগাতে হবে। যদি কোনো কলের বিষয়ে সন্দেহ হয়, তবে অবশ্যই পুলিশকে অবহিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। তিনিও এ ধরনের ফোন কল পুনরায় যাচাই করার পরামর্শ দেন।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত