রোগী হিসাবে এখন আমার ঘুমানোর কথা, কিন্তু উঠে বসলাম হাবিজাবি লিখতে, এই স্নিগ্ধ সকালে। ফজরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগেই ঘুম ভাঙ্গে সাধারণত: এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। নামাজটা পড়ে জানালার পর্দ্দাটা টেনে কাঁথাটা গায়ে দিয়ে আরামের একটা ঘুম দিতে পারতাম অন্তত নয়টা পর্যন্ত, সেটাই হয়তো উচিত। ডক্টরও তাই বলেন।
মানুষের কেমিস্ট্রি বড় অদ্ভুত। ডক্টরের কথা রোগী শুনেনা, শিক্ষকের কথা ছাত্রছাত্রীরা শোনে না, সন্তানেরা শোনেনা বাবা-মায়ের কথা। এটা মানুষের দোষ নয়, বৈশিষ্ট্য। বাবা আদম ও মা হাওয়া সেই যে মাবুদের কথা না শুনে নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন আমরা তা থেকে শিক্ষা নিইনি, করে যাচ্ছি একই ভুল। তাইতো ডাক্তার বা নিকটজনদের কথা মত না ঘুমিয়ে লিখতে বসলাম হাবিজাবি।
মাঝে মাঝে মনে হয় কেন লিখি এতসব?লিখতে বসে আমি কপটতা করিনা। তাই কত কথা মানুষ জেনে যায়। কি দরকার ঘরের কথা পরকে জানানোর? বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই জানেন মুখে কুলুপ আঁটা লোকজন এদেশে শাইন করে, কথা বলা লোক ধরা খায় কোন না কোন সময়ে। আমি তো এটা বুঝি তারপর কেন লিখি?
কৈশোরে একটা গান আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। শিল্পি কে মনে নেই, সময়ে সময়ে গুনগুন করতাম
‘‘তুমি চেয়েছিলে ওগো জানতে,
কেন এতভালো লাগে তোমাকে,
আমি বহুবার ভেবে দেখেছি,
তার উত্তর কিছু পাইনি‘’
তখনো কাউকে আলাদা করে ভালোলাগার বয়স শুরু হয়নি যে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গাইতাম। গানটি এখনো ভালো লাগে, বউয়ের সামনে যদি এখনো গাই গানটি বলে,ঢং করো, নতুন কোন ড্রেস পরলাম, বা একটা দুল পরলাম বা সাজলাম চোখে পড়লনা আর গাও কেন এত ভাল লাগে তোমাকে? পুরুষ মানুষের আবার বউ ভাল লাগে? ঢং…আরো বহু কথা। আমি কিছু বলি না, হাসি।
জাতিসংঘ মিশনে ছিলাম কসোভাতে। আমার কাজ ছিল সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম লিডার। মিশনে সিস্টেম তদন্ত শেষে প্রসিকিউটের মতামত নিতে হয়। আমার টিমের জন্য এসাইন্ড প্রসিকিউটর ছিলেন কানাডার রিটায়ার্ড ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ষাটোর্ধ এলিজাবেথ। মহিলা অসম্ভব সুন্দরী এবং সদা হাস্যময়ী।
তার পাশের রুমে আমাদের বাংলাদেশের একজন সিনিয়র অফিসার বসতেন। খুবই স্বল্পভাষী ভদ্রলোক ছিলেন সেই স্যার। মিশনের রুমগুলো সাধারণত: দেয়াল ঘেরা নয়, ওয়ার্ক স্টেশন টাইপের। সবার সব কথাই সবাই শুনতে পায়। ইউএন কালচারই হচ্ছে অফিসে ওয়াশরুম আর পিসি ছাড়া (সীমিত পরিসরে) প্রাইভেসির কোন স্থান নেই। তো স্যার ভাবীর সাথে প্রতিদিন কথা বলেন। এটাই স্বাভাবিক। বিদেশে থাকলে পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলা হচ্ছে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তো ভাবী নিশ্চয়ই অনেক কথা বলেন, স্যার 20/30 সেকেন্ড পরে একবার বলেন ‘‘আচ্ছা’’,
প্রতিদিন স্যারের মুখে একই শব্দ শুনে এলিজাবেথ খুবই কৌতুহলী। এর্টনী জেনারেল হোক, আর যাই হোক নর্থ আমেরিকান হোক আর এশিয়ান হোক নারীতো (সকল নারীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান ও আস্থা রেখে বলছি)। নারীসুলভ কৌতুহল থেকে একদিন আমাকে বলল” মনির আচ্ছা মানে কি? আমি বললাম আচ্ছা মানে ইয়েস। মিশনে সবাই সবাইকে সাধারণত নাম ধরে ডাকে। স্যারের নাম ধরে উনি বললেন উনি খুবই বুদ্ধিমান। স্যারের সাথে এর্টনির কোন কাজ নেই, সে হঠাৎ করে স্যার কে বুদ্ধিমান বলছে কেন?এবার আমার কৌতুহলের পালা।
এলিজাবেথের বক্তব্য হচ্ছে ওর মিসেস যাই বলুক সে মিটিমিটি হাসে আর কিছুক্ষণ পরপর বলে “আচ্ছা” বউকে যে সব কথায় আচ্ছা বলতে পারে সে হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান পুরুষ। এরপর এলিজাবেথের তার জীবন দর্শন কিছুটা শেয়ার করলো আমার সাথে কফির টেবিলে।বলল আমি অনেক পর পার্টনার পাল্টেছি, তিনবার ডিভোর্স করেছি বা করতে হয়েছে। আমার মেয়ের বয়স মনি 36। সেও একবার ডিভোর্স করেছে। অন্য কোনো কারণ নেই, কারণ এই আচ্ছা- ইয়েস বলতে না পারা।
পেশায় আইনজীবী তো খালি মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি। স্যার কে কফির টেবিলেই একদিন ধরেও ছিলেন, সাথে ছিলাম আমি। স্যার কে বললেন “বউকে খুব ভালবাসো? স্যার কিশোরের মত লজ্জা পেলেন, পাশে আমি তার জুনিয়র কলিগ।
স্যার তার মাপা হাসি দিয়ে বললেন ‘‘বাসিই তো, আমাদের কালচারে তো বউ ছাড়া কিছু নেই, ভালো তো বাসিই। স্যারের হালকা কথায়ও এর্টনি হাসলেন না, বললেন এতটাই যে, সব সময় “ইয়েস” বলতে পারো?
এবারে স্যার তার ক্যারিশমা দেখালেন। অল্পভাষী লোক বুদ্ধিমান হয়। স্যার ভীষন বুদ্ধিমান। বললেন আমি বাইরে থাকি, সে একা থাকে, বাচ্চা-কাচ্চা সংসার,স্বামী পাশে নেই,সব নিয়ে তার কত ঝামেলা!!
হয়তো বললো গতকাল ফোন করোনি কেন? আর কোনদিন যদি মিস করেছ তো খবর আছে।স্যার বললেন “আচ্ছা”
আচ্ছা থিওরি খুবই কাজের। আমি স্যারের মতো বুদ্ধিমান নই। তবে মাঝে মাঝে বোকারাও বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে। আমিও এই আচ্ছা তত্ত্ব মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে এপ্লাই করি। ফলাফল? নারী বিষয়ে সকর থিওরিই রিলেটিভিটি সম্পর্কিত।তবে মোটামুটি কাজে লাগে একথা সত্য।
শিবের গীত বাদ দেই। লিখতে বসেছিলাম করোনার সাতকাহন চলে গেলাম কোথায়। তো কাহিনীতেই ফিরি। বাসা থেকে হাসপাতালে আসার কাহিনী গত পর্বে বলেছি। বাসা থেকে আসার সময় ছোট্ট একটি ব্যাগের সাথে যে জিনিসটা নিয়ে এসেছি সেটি হচ্ছে পবিত্র কোরআন শরীফ। যদিও কোরআন আমি মোবাইলে পড়ি সেটিই সহজ, বাট কোরআন শরীফটা আনার কারণ হলো অনুভূতি। মোবাইলে কোরআন পড়লে যে অনুভূতি হয় কোরআন শরীফ দেখে পড়লে কেন জানি অন্তত: আমার ক্ষেত্রে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে।
হাসপাতালের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে ডাক্তার সাহেব কে বিদায় দিয়ে ডিনার শেষ করলাম দশটার দিকে। এগারোটার দিকে ফোন করে বউ-বাচ্চাকে বললাম ডাক্তার ঘুমাতে বলেছে ঘুমাব। ওরা অবাক হয়েছে, রাত ১১ টায় আমাকে কখনো ওরা ঘুমাতে দেখেনি। ভাবছে অসুস্থ মানুষ ঘুমালে ভালো। ওযু করে শুয়েও পরলাম। কিন্তু কোথায় ঘুম? অনেক এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে কোরআন শরীফ নিয়ে বসলাম।
মন খারাপ হলে কোরআন শরীফের কয়েকটি সুরা আমি পড়ি বা তিলাওয়াত শুনি। সূরা ইয়াসিন, সূরা আর রহমান, সূরা মূলক, সুরা ওয়াক্কিয়া ইত্যাদি একটু বেশী শোনা হয়।মিশরীয় উচ্চারন আমার ভীষণ ভালো লাগে।