বদলে গেছে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। নেই সেবাপ্রার্থীদের ভিড়; দালালের উৎপাত। যাবতীয় কার্যক্রম এখন অনলাইনে-ইন্টারনেটে। কাগজ-কলম ছাড়াই চলছে দাফতরিক কাজ।
স্কুল-কলেজে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) থেকে শুরু করে ফরমপূরণ, ফলাফল ঘোষণা সবই হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। সনদ (সার্টিফিকেট), নম্বরপত্রসহ (মার্কশিট) যাবতীয় কাগজপত্রের প্রয়োজনীয় সংশোধন সম্ভব হচ্ছে ঘরে বসেই। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়নে গ্রহণ করা হচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। ফলে একদিকে যেমন সময়, শ্রম, অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে কমেছে হয়রানি ও দুর্নীতি।
সরেজমিন যশোর শিক্ষা বোর্ড ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে খুলনা বিভাগের দশটি জেলার ২ হাজার ৯২৪টি স্কুল ও ৫৮৪টি কলেজ রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষক ও ১৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। বছরের পর বছর এইসব শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বোর্ডসংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম হাতে-কলমে সম্পাদিত হত। ফলে সময়, শ্রম, অর্থ ব্যয় করেও ন্যূনতম সেবা পেতে ঘুরতে হত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রথম ২০১১ সালে ডিজিটাল পরিষেবা শুরু করে। তবে প্রকৃত অনলাইন সেবা প্রদান শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। এখন অনলাইনে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) থেকে শুরু করে ফরমপূরণ, ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে এসএমএস’র মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ফলাফল, বৃত্তিপ্রাপ্তির তথ্য। অনলাইনে হচ্ছে সনদসহ সকল কাগজপত্রের যাবতীয় সংশোধন।
এছাড়াও অনলাইন প্রশ্নব্যাংক, ফলাফল আর্কাইভ, স্টুডেন্ট প্রোফাইল, বায়োমেট্রিক উপস্থিতিসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের বাটন ও কি-বোর্ড চেপে। এমনকি বোর্ডে এখন আর হাতে লেখা (ম্যানুয়াল) কোনো আবেদন গ্রহণ করা হয় না। সব আবেদনই করতে হয় অনলাইনে।
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন জানান, যশোর বোর্ড এখন অনলাইন বোর্ড। এখানে শতভাগ সেবা অনলাইনে প্রদান করা হয়। সেবার জন্য এখন আর কাউকে বোর্ডের দরজায় ধর্ণা দিতে হয় না।
ঘরে বসেই সংশোধিত সনদ
ঘরে বসেই সংশোধিত সনদসহ সকল কাগজপত্র পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য এখন কাউকে আর বোর্ড অফিসে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে না। বোর্ডের ওয়েবসাইটে আবেদন করে সোনালী ব্যাংকের সোনালী সেবার স্লিপ প্রিন্ট করে ব্যাংকে টাকা জমা দিলেই শুরু হয়ে যায় সংশোধনের কাজ। সেবা গ্রহীতাকে বোর্ড পর্যন্ত আসতে হয় না। কোথাও ছুটতেও হয় না।
সংশোধন হয়ে গেলে বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে প্রিন্ট কপি ডাউনলোড করে নেয়া যায়। এমনকি কোনো দরকারি প্রয়োজনে সার্টিফিকেট কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেখাতে চাইলে সাইটের নির্ধারিত অপশন থেকে প্রর্দশনও করা যায়। আগে এই কাজের জন্য দিনের পর দিন বোর্ডে এসে ধর্ণা দিতে হত। আর তার সুযোগ নিত দালাল শ্রেণি।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা জানান, ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত প্রায় ২১ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। আবেদন নিষ্পত্তি করে দ্রুত সনদ প্রদানের হার প্রায় ৯০ ভাগ। বাকিদের তথ্য বা কাগজপত্রে ঘাটতি-অসংগতি বা যোগাযোগহীনতার কারণে বিলম্ব হয়ে থাকে। সনদে বয়স বা বড় ধরনের সংশোধনের আবেদন এলে প্রার্থীকে একবারই বোর্ড মিটিংয়ে এসে আবেদনের যথার্থতা প্রমাণ করতে হয়।
অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ
যশোর শিক্ষা বোর্ডের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি, বদলি, রেজিস্ট্রেশন, ফরমপূরণ সবই অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে কমেছে ভুলের পরিমাণ, হয়রানি, দুর্ভোগ ও দীর্ঘসূত্রিতা।
যশোর কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তাক হোসেন শিম্বা জানান, আগে রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ ম্যানুয়ালি হত। ভুলের মাত্রা তুলনামূলক বেশি ছিল। এখন পুরোটাই অনলাইনে সম্পন্ন হয়। অভিভাবকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়। অনলাইনে তথ্যপূরণের পর যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। ফলে ভুলের মাত্রা কমেছে।
তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশন থেকে সার্টিফিকেট পর্যন্ত পুরোটাই অনলাইন নির্ভর হওয়ায় বোর্ডে ছুটোছুটি করতে হয় না।
যশোর বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন জানান, এসব প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পন্ন হওয়ায় কাজের গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
বোর্ডের প্রশ্নব্যাংক
বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে যশোর বোর্ড প্রশ্নব্যাংক সফ্টওয়্যার তৈরি করে। এই সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন। বোর্ডের দক্ষ মডারেশন সেল প্রশ্ন যাচাইবাছাই করে ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করে। এতে শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দক্ষতা বাড়ছে।
আর বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রশ্নব্যাংক থেকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক, প্রাক-নির্বাচনী, নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে কমেছে গাইড নির্ভরতা, প্রশ্নফাঁসের অপতৎপরতা।
যশোরের শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বুলবুল জানান, এখন বোর্ডের প্রশ্নব্যাংকের কারণে মানসম্মত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হচ্ছে। মূলবই থেকে প্রশ্ন হওয়ায় গাইড নির্ভরতা কমেছে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই সৃজনশীল প্রশ্নোত্তরে দক্ষ হচ্ছে। পরীক্ষার কিছু সময় আগে বোর্ড অনলাইনে প্রশ্নপত্র দিয়ে দেয়ায় ফাঁসের ঝুঁকি বা প্রবণতাও কমে গেছে।
পরীক্ষা পদ্ধতি, ফলাফল
যশোর বোর্ডের পরীক্ষার কার্যক্রম ও ফলাফল প্রকাশ অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ফরমপূরণের পর অনলাইনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে প্রবেশপত্র। বোর্ড পরীক্ষার পর (জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি) সকল শিক্ষার্থীর ফোনে এসএমএস’র মাধ্যমে ফলাফল পাঠানো হচ্ছে। এমনকি বৃত্তিপ্রাপ্তির তথ্যও এসএমএসের মাধ্যমে অবহিত করা হচ্ছে। এই কার্যক্রম দেশের অন্য কোনো বোর্ডে নেই।
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, এখন আমরা পরীক্ষার কেন্দ্র থেকেই ওএমআর শিটের স্ক্যানকপি গ্রহণের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করছি। আগামী এইচএসসি পরীক্ষা থেকে এটি ইমপ্লিমেন্ট শুরু হবে। এর মাধ্যমে পরীক্ষা কার্যক্রমের একটি বড় কাজ কেন্দ্র থেকেই সম্পন্ন হয়ে আসবে। যা ফলাফল প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে সহজ করবে। যশোর বোর্ডই প্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
স্টুডেন্ট প্রোফাইল
যশোর শিক্ষা বোর্ড ‘স্টুডেন্ট প্রোফাইল’ তৈরির একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বোর্ডের অধীনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর এই প্রোফাইল থাকবে। স্বতন্ত্র এই প্রোফাইল শিক্ষার্থী সারাজীবন ব্যবহার করতে পারবে। এখানে তার যাবতীয় তথ্যের পাশাপাশি পরীক্ষার ফলাফল সংক্রিয়ভাবে যুক্ত হবে। এছাড়া তার ব্যক্তিগত অর্জনগুলোও সে সংযুক্ত করে রাখতে পারবে। চলতি বছরেই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল তৈরির মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে।
সফ্টওয়্যারটি তৈরির দায়িত্বে থাকা যশোর বোর্ডের সহকারী প্রোগ্রামার মুরাদ হোসেন বলেন, এটি তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এই স্টুডেন্ট প্রোফাইল হবে শিক্ষার্থীর সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা। এর লিংক দিয়েই সে তার পুরো বায়োডাটা দেখাতে বা ব্যবহার করতে পারবে।
বায়োমেট্রিক উপস্থিতি নিশ্চিত ও মনিটরিং
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে উপস্থিতি নিশ্চিতের প্রক্রিয়াটি সকলেরই জানা। যশোর বোর্ড এই পদ্ধতিটি কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করার উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শিক্ষার্থী বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। এই উপস্থিতি বোর্ডের ওয়েবসাইটেও সংরক্ষিত থাকবে। ফলে বছর শেষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার পাওয়া যাবে। আর কম উপস্থিতির হার থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফরম পূরণ হবে না।
বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানী জানান, সারাবছর ঠিকমতো ক্লাস না করা শিক্ষার্থীরও এসএসসি বা এইচএসসি’র ফরম পূরণের জন্য অনেক সময় প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের ওপর চাপ থাকে। কোথাও কোথাও এনিয়ে অনৈতিক তৎপরতাও হয়। বোর্ড কেন্দ্রীয়ভাবে এটি মনিটরিং করলে সেই সুযোগ আর থাকবে না।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন জানান, যশোর বোর্ড এখন অনলাইন বোর্ড। এখানে শতভাগ সেবা অনলাইনে প্রদান করা হয়। সেবার জন্য এখন আর কাউকে বোর্ডের দরজায় ধর্ণা দিতে হয় না। সকল আবেদন অনলাইনে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে সেবা প্রদানের হার বেড়েছে; কমেছে ভোগান্তি ও অনিয়ম।
তিনি বলেন, এখন শিক্ষকদের শুধু পরীক্ষার খাতা গ্রহণের জন্য বোর্ডে আসতে হয়। আর সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে যারা সংশোধিত সনদপত্রের মূলকপি গ্রহণ করতে চান, তাদেরকে পূর্বের কপি জমা দিয়ে তা গ্রহণের জন্য আসতে হয়। এর বাইরে আর কাউকে কোনো কাজে বোর্ডে আসার প্রয়োজন হয় না। অনলাইনের মাধ্যমেই সব কাজ সম্পন্ন হয়।
চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন আরও জানালেন, যশোর বোর্ড শুধু নিজস্ব কার্যক্রমই করছে না, আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে ঢাকা বোর্ড ও ময়মনসিংহ বোর্ডেরও অনলাইন সেবা প্রদান করছে। ফলে বদলে যাওয়া যশোর বোর্ড এখন অনেক ইনোভেটিভ কাজের পথপ্রদর্শক।
সূত্র- জাগো নিউজ