আজ - শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - রাত ১:৩৪

ভয়ংকর হচ্ছে খুলনা-রাজশাহী

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাজশাহী শহরকে। জেলা প্রশাসন এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, সিটি করপোরেশন এলাকায় আগামী ১৭ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে এই ‘লকডাউন’। এদিকে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় খুলনা জেলায় নতুন করে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আগামীকাল রবিবার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর আগে গত ৩ জুন থেকে খুলনা সদর, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর ও জেলার রূপসা থানায় বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়।

এদিকে দেশের সীমান্ত এলাকায় গত বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই সময়ে আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুরে ২ জন, মোংলায় ১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা। 

রাজশাহীতে লকডাউন : রাজশাহী থেকে দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, গত ঈদের পর থেকেই রাজশাহীতে বাড়তে থাকে করোনা রোগী। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে জরুরি সভায় বসে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউনের।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে ১৭ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, বিপণিবিতান, দোকান, রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকবে। তবে ওষুধ, কাঁচাবাজার, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন ও সৎকারের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান এই লকডাউনের আওতাবহির্ভূত থাকবে।

এই বিধিনিষেধ চলাকালে বাস, ট্রেনসহ কোনো ধরনের যানবাহন রাজশাহী মহানগরে প্রবেশ করতে পারবে না এবং রাজশাহী মহানগর থেকে বের হতে পারবে না। তবে আমসহ কৃষিপণ্য, খাদ্যসামগ্রী পরিবহন, রোগী পরিবহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবাদানকারী পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। প্রজ্ঞাপনে জনসমাবেশ হয় এমন যেকোনো ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, রাত থেকেই লকডাউনের বিষয়ে বিধিনিষেধগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পুলিশ মাইকিং শুরু করেছে। নগরে এই সাত দিন কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সে বিষয়ে মানুষকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকে এই প্রচারণা আরও ব্যাপকভাবে চলছে।

এদিকে লকডাউনের খবরে শুক্রবার সকালে চাপ বাড়ে বাজার ও বিপণিবিতানগুলোতে। শুক্রবার সকাল থেকেই বাজারে ভিড় বাড়তে শুরু করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকেই শেষ হতে শুরু করে সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহীর অন্যতম বড় তিন বাজার সাহেববাজার, লক্ষীপুর ও কোর্ট বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও আলু কিনছিলেন। অনেকেই কিনছেন মাছ-মাংস। কেউ কেউ আবার বাড়তি সবজিও কিনে নিয়ে গেছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, রাজশাহীতে সাধারণত শুক্রবার একটু বাড়তি বাজার হয়। অনেকেই ছুটির দিনে একটু বেশি কেনাকাটা করেন। তবে আগামী ৭ দিনের লকডাউনের কারণে মানুষ একটু বেশি করে কিনছেন। ক্রেতাদের অভিযোগ, চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দামও বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা। 

রাজশাহী মহানগর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফাইজুল ইসলাম বলেন, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ইত্যাদির সরবরাহে ঘাটতি নেই। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটা করছে। তাই কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে। তবে সবাই যাতে কম কম করে বাজার কেনে সেই পরামর্শ দেন এই ব্যবসায়ী।

খুলনায় নতুন বিধিনিষেধ : করোনাসংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে খুলনা জেলায় নতুন করে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী রবিবার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর আগে গত ৩ জুন থেকে খুলনা সদর, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর ও জেলার রূপসা থানায় বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়।

বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে, বিকেল ৫টার পর কোনো দোকান, শপিং মল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি খোলা রাখা যাবে না। তবে সকল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হয়ে অযথা ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। ইজিবাইক চলবে অর্ধেক এবং অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে। কাঁচাবাজার ও ওষুধের দোকান এই বিধিনিষেধ আওতামুক্ত থাকবে।

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। সভায় খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।

তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, গত এক সপ্তাহ খুলনার কয়েকটি জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করে সংক্রমণ প্রতিরোধে কোনো ভালো ফল পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে সমগ্র জেলায় বিধিনিষেধ আরোপ ও তা বাস্তাবায়ন করতে না পারলে খুলনার করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে না। তিনি রাস্তাঘাটে অযথা জটলা করে আড্ডা দেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালনের জন্য খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান।

খুলনা জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ৯১ জন। জুন মাসের গত ১০ দিনে ৮৬৪ জন আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৮ জুন সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৫১ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। শুক্রবার শনাক্ত হয় ১৫৬ জন। এটা এখন পর্যন্ত এ মাসের সর্বোচ্চ।

রামেক হাসপাতালে আরও ১৫ মৃত্যু : করোনায় মৃত্যুর মিছিল থামছেই না রাজশাহীতে। ১১ জুন শুক্রবার সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ও করোনা ওয়ার্ডে আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ১৫ জনের মধ্যে ৭ জন করোনা পজিটিভ ছিলেন। অন্য ৮ জন নমুনা পরীক্ষার আগেই মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস। এদের ৮ জনই রাজশাহীর। অন্যদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৬ জন ও নাটোরের একজন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বর্তমানে ১০টি ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। এসব ওয়ার্ডে ২৭১টি বেড থাকলেও ১১ জুন শুক্রবার সকালে সেখানে রোগী ভর্তি ছিল ২৯৭ জন। বাড়তি রোগীদের ওয়ার্ডগুলোর বারান্দা ও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের সবারই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেন লাগছে না, করোনা আক্রান্ত এমন রোগীদের এখন আর হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।

ফরিদপুরে করোনায় আরও দুজনের মৃত্যু : ফরিদপুরে গত এক সপ্তাহ ধরে কভিড-১৯ রোগীর শনাক্তের হার বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় করোনা পজিটিভ হয়েছে আরও ১৮ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দিকুর রহমান জানান, হঠাৎ করে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর সব কয়টি বেড পূর্ণ রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৮টি করোনা পরীক্ষায় ১৮ জন পজিটিভ হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত মোট করোনা রোগী সংখ্যা ১০ হাজার ৮৩৩ জন আর মারা গেছে ১৮৭ ব্যক্তি।

মোংলায় ১০ দিনে গড় শনাক্ত ৬৫ শতাংশ : শুক্রবারও মোংলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দুজন ও বুধবার একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে তিন দিনে মোংলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনায় আক্রান্ত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাহের হাটের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মোংলায় গতকাল সংক্রমণের হার ছিল ৫০ শতাংশ। তবে গত ১০ দিনের গড় হিসাবে এই হার ৬৫ শতাংশ। তারপরও মোংলা উপজেলায় প্রশাসনের আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধ ঢিলেঢালাভাবে চলছে। মোংলা পৌরসভা এলাকায় দোকানপাট বন্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষ নানা অজুহাতে বাইরে ঘোরাফেরা করছে। বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, মোংলা উপজেলায় প্রতিদিন সংক্রমণের হার ওঠানামা করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলছে সংক্রমণের এই হার আরও বাড়াতে পারে।

যশোরে শনাক্তের হার ৪৪ শতাংশ : যশোরে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১২৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শুক্রবার শনাক্তের হার ৪৪ শতাংশ। এই অবস্থায় যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ডেডিকেটেড ওয়ার্ডের বেডের সংখ্যা ৪০টি থেকে ৮০টিতে বাড়ানো হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে প্রশাসন। গত ২৪ ঘণ্টায় যশোর পৌর এলাকায় মোবাইল কোর্টে ৩৯টি মামলায় প্রায় ৩৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

মাগুরায় আশঙ্কাজনক হারে সংক্রমণ বাড়ছে : মাগুরায় আশঙ্কাজনক হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। সন্দেহভাজন রোগী ও শনাক্তের সংখ্যা বিবেচনায় গত মে মাসের তুলনায় চলতি জুন মাসের প্রথম ১০ দিনেই আক্রান্তের হার প্রায় তিন গুণ। জুনের প্রথম ১০ দিনে জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ জন। এদিকে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জেলা প্রশাসক। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা খুবই কম।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে সন্দেহভাজন মোট ৩২৭টি নমুনা পরীক্ষার ফল পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৪৪ জন করোনা পজিটিভ এসেছে। যার হার প্রায় ১৪ শতাংশ।

অন্যদিকে মে মাসে মোট ৫৬২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩২ জন পজিটিভ হিসেবে আক্রান্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছে মোট ১২৯৮ জন। সুস্থ হয়েছে ১২২২ জন। হোম আইসোলেশনে আছে ৪৮ জন। এ পর্যন্ত জেলায় করোনায় মারা গেছেন মোট ২৪ জন।

মাগুরা সিভিল সার্জন ডাক্তার শহীদুল্লাহ দেওয়ান বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সকলকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এ অবস্থায় এখনই সচেতন না হলে আগামী দিনগুলো উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত