নাঈম সাব্বির, (স্পেশাল করসপন্ডেন্ট পলিটিক্স): তালুকদার আব্দুল খালেক শুধু একজন ব্যাক্তিই নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। খুলনা অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে উত্থান হয়ে খুলনা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কমিশনার নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশের পর, আট বার বিভিন্ন নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছেন এবং ৭ বার জয়ী হলেও ২০১৩ এর খুলনা সিটি নির্বাচনে তাকে জীবনের প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করতে হয়। একজন কমিশনার থেকে সংসদ সদস্য, সংসদ সদস্য থেকে বাংলাদেশ সরকারের সফল মন্ত্রী। তারপর খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র।
বাংলাদেশের মন্ত্রিত্ব পেয়ে দুর্নীতি মামলা খায় নাই, এমন মন্ত্রীর সংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে মন্ত্রী হলে দুর্নীতি করুক না করুক ক্ষমতার পালা বদল হলেই মামলা নিশ্চিত। যে কজন ক্লীন ইমেজের মন্ত্রী ক্ষমতার পালা বদল এমন কি ১/১১ এর পরেও মামলা খায়নি, তাদের মধ্যে তালুকদার আব্দুল খালেক অন্যতম।
ভোটের রাজনীতিতে খালেক তালুকদার একজন সফল মানুষ। জীবনের প্রথম নির্বাচনে কমিশনার হবার পর বাগেরহাট-৩ {রামপাল-মংলা }আসন থেকে বার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১/১১ এর পর খুলনার মেয়র হওয়ার কারনে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, সেই আসন থেকে তার স্ত্রী ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়। তার দক্ষতা ও যোগ্যতায় দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিতে অনন্য শিখরে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে স্বক্ষম হন। যার কারনে দলের হাই কমান্ডের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং দলীয় প্রধান সহ কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের কাছে খালেক তালুকদার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। সে কারনে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতি বা উন্নয়ন পরিকল্পনা সহ সকল সিদ্ধান্তের বিষয়ে তার মতমতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। একটা পর্যায়ে দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এর সাথে মাধ্যমহীন যোগাযোগ গড়ে ওঠে, পরবর্তীতে এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। শুরু হয় তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র এবং দলীয় প্রধানের কাছে তার এই গ্রহণযোগ্যতা কমানোর জন্য জরুরী প্রয়োজন ছিল একটা পরাজয়ের। আর তাই আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ক্ষমতাশালী একটা গ্রুপ ২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের তিলক টি, খালেক তালুকদারের ললাটে পরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অত:পর দক্ষিনাঞ্চেলের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একটা অংশ এবং বিত্তবানদের বড় একটা অংশ খালেক তালুকদারকে হারানোর জন্য পরিকল্পিত ভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এমনকি সিটি কর্পোরেশনের দূর্নিতী পরায়ন কর্মকর্তা কর্মচারী এবং অনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ঠিকাদাররা, বিশেষ মিশন নিয়ে এই চক্রের সাথে মিলিত হয়ে, খালেক বিরোধী ষড়যন্ত্র সিন্ডিগেট গড়ে তুলেছিলো।
নির্বাচন পরিচালনা পর্ষদ সহ সকল কার্যক্রমে ষড়যন্ত্রকারীদের অশংগ্রহণ ছিলো লোক দেখানো আন্তরিকতা এবং পিছনে ছিলো গভীর ষড়যন্ত্র, যখন খালেক তালুকদার বুঝতে পারলেন তখন কিছু তার করার ছিলো না। খালেক ভাই পরাজিত হলেও ষড়যন্ত্রকরীরা বিজয়ী হয়।
ভোটের হিসাব (২০০৮ ও ২০১৩):
২০০৮ এর নির্বাচনে মোট ভোটার-৩,৯৯,৩৯৮ এর মধ্যে কাস্ট হয় ৩,১০,৭৯১ ভোট ৭৭.৮১%। খালেক ভাই -১,৫৭,৮১২ ভোট, মনি ভাই – ১,৩১,৯৭৬, ফিরোজ ভাই – ১৪,২২৩ এবং অন্যরা তিনজন মিলে ৪,৬৯৪ ভোট। এত প্রতিকুলতার ভিতরও খালেক ভাই ২৫,৮৩৬ ভোটে বিজয়ী হন।
২০১৩ এর নির্বাচনে মোট ভোটার- ৪,৪০,৫৬৬ এর মধ্যে কাস্ট হয় ৩,০২,৫১৯ ভোট ৬৮.৭০%। মনি ভাই – ১,৮০,০৯৩ ভোট এবং খালেক ভাই -১,১৯,৪২২ ভোট। বিগত ৫ বছর খুলনার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেটের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার পরও খালেক ভাই ৬০,৬৭১ ভোটে পরাজিত হন এবং ৪১,১৬৮ জন নতুন ভোটার যোগ হলেও গত নির্বাচনের চাইতে ৩৮,৩৯০ ভোট কম পান। আরো বড় বিষয় হলো এ নির্বাচনে খালেক ভাই আর মনি ভাই ছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী ছিলোনা।
২০১৮ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনে ৫২৮৮৮ নতুন ভোটার যুক্ত হয়ে মোট ভোটারের সংখ্যা হয়েছে – ৪,৯৩,৪৫৪। যার প্রায় সম্পূর্ণটাই তরুন প্রজন্ম।
বাস্তবতা: # ২০০৮-১৩ এর ৫ বছর খুলনা সিটি কর্পোরেশনের জন্য এত বেশী উন্নয়ন বরাদ্দ তিনি আনতে পেরেছিলেন যা খুলনার ইতিহাসে আর কেউ পারেনি। তার সময়ের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প এখনও চলমান রয়েছে। তার আত্ব বিশ্বাস এতটাই ইস্পাত কঠিন ছিলো যে, খুলনার উন্নয়নের চিত্র দৃশ্যমান তাই এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে খুলনাবাসী দল মত নির্বিশেষে তাকে আবার মেয়র হিসাবে নির্বাচন করবে। তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এতটাই কৌশলী ছিলো যে, শ্রমজীবি মানুষ ছাড়া অধিকাংশ ভোটাররাই বিভ্রান্ত হয়েছিলো। এ কারনে ২০০৮ এর চাইতে ২০১৩ তে ভোটার উপস্থিতি কম ছিলো। যাদের দ্বারা মিথ্যা অপপ্রচার পরিচালিত হয়েছিলো নির্বাচনের পর তা সবাই বুঝতে পেরেছিলো এবং সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা শোণা যেতো, বড় ভুল হয়ে গেলো।
খুলনা-৩ বরাবরই আওয়ামীলীগ এর শক্ত ঘাটি কিন্তু মজার বিষয় হল ১৯৭২ সালে মরহুম এম,এ বারি সাহেব ছাড়া কেউ আজ পর্যন্ত (৫ জানুয়ারি’ ১৪ এর নির্বাচন আলোচ্য নয়) খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা থানা নিয়ে গঠিত খুলনা- ২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হল কেন আওয়ামীলীগ সংসদ নির্বাচনে জিততে পারেনা? উত্তর হল কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কারসাজির জন্যই আওয়ামী লীগ সদর থেকে জিততে পারেনি। যেমন পারেনি ১৯৯৬ সালের আওয়ামীলীগের জোয়ারে কিংবা ২০০৮ সালের গণজোয়ারের সময়ও। অতএব মেয়র নির্বাচনে খুলনা-২ আসনই আওয়ামীলীগ এর হার-জিত নির্ধারণ করে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের এবারের ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৪ যা গত নির্বাচনের চাইতে ৫২৮৮৮ নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। যার অধিকাংশই তরুন এবং এবারের মেয়র নির্বাচনে তরুন ভোটাররাই মূল নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় থাকবে। বিশেষ করে নবীন ভোটার অনেক বেশী সচেতন এবং তারা কারো মিথ্যা প্ররোচনায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবে না। দলীয় প্রতীক এর উপর তাদের অন্ধত্ব নাই তাই বাস্তবতার ভিত্তিতে তারা পরিচালিত হবে। বিগত ২ পর্বের মেয়র আর তাদের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করেই বর্তমান সচেতন নাগরিকরা তাদের ভোট প্রদান করবে। কঠিন সত্যটি সর্বস্তরের মানুষ বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশে সরকার দলীয় প্রার্থী মেয়র না হলে নগরবাসীর কাংখিত উন্নয়ন চাহিদা পুরোন হয় না তা সবাই বলছে। এবার দলীয় প্রতীক এ নির্বাচন হচ্ছে যেহেতু সেহেতু দলের বিবেদিত নেতা কর্মী সমর্থক এবার দলের বাইরে ভোট দিবে না। প্রধান দুটি দলের মহানগর প্রধান দুজন মেয়র প্রার্থী এতএব বেশ প্রতিদন্দিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। এবার স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তি কিন্তু বিগত দিনের চাইতে অনেক বেশী সংগঠিত। এছাড়া প্রধান দুটি দলের নেতা কর্মীরা মর্যাদার লড়াই এ নিবেদিত ভাবে কাজ করছে। নিজ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নিজেদের সকল বিভেদ ভুলে কাধে কাধ মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচারাভিজানে কাজ করছে। অতএব এ ধারার অব্যহত থাকলে এবং বিগত দুটি নির্বাচনকে বিশ্লেষন করে সার্বিক বিবেচনায় এটা অনুমান করা যায়, তালুকদার আব্দুল খালেক বিপুল ভোটের ব্যাবধানে বিজয়ী হবেন।