মোশাররফ করিম। অভিনেতা ও লেখক। অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চনাটক ও কবিতা লেখেন তিনি। লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫টি বিষয় নিয়ে
১. বই
এই জীবন, পেশা আর যান্ত্রিকতার বাইরে নিয়ে যায় ‘রূপসী বাংলা’
জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা আমার প্রিয় বই এবং এই একটি বইকে অনেক ক্ষেত্রে বলা যায় আমার ওষুধ। আমি অবসাদগ্রস্ত থাকলে, ক্লান্ত থাকলে, কোনো কারণে ভারাক্রান্ত থাকলে রূপসী বাংলা পড়ি। এই যে কথাটি বললাম, এটি কেবল কথার কথা নয়, আসলেই এই বইয়ের কবিতাগুলো আমাকে এই নগর, এই জীবন, এই পেশা আর এই যান্ত্রিকতার বাইরে নিয়ে যায়। আমি আনন্দ পাই। ক্ষণিকের জন্য হলেও ভিন্ন এক জগতে চলে যাই। আমার বাড়ি বরিশাল। বরিশালকে খুব ভালোভাবে চিনি আমি। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর মাধ্যমে আরও ভীষণভাবে আমি উপলব্ধি করি বরিশালকে।
২. শখ
পুরোনো জিনিসের মধ্যে ভেসে ওঠে কল্পিত কাল
আমার প্রিয় শখ পুরোনো জিনিস, হারিয়ে যাওয়া জিনিস—এসব সংগ্রহ করা। আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। সুতরাং ভবিষ্যতের জিনিস কী করে সংগ্রহ করব? আরও অনেকের মতোই অতীত আমাকে টানে, হারিয়ে যাওয়া জিনিস আমাকে টানে। ছোটবেলা থেকেই একটু পুরোনো জিনিসপত্র—পুরোনো কলম, ঘড়ি, রেডিও—এই পুরোনো জিনিসের মধ্যে আমি কী যেন পাই। ‘কী পাই’ বলতে গেলে বলতে হবে, যেমন শ্যাওলা–ধরা কোথাও কোনো একটা পুরোনো মঠ, কি পুরোনো দালান, যা দেখলেই মনের মধ্যে একটা কল্পিত কাল তৈরি হয়, একটা আবছামতো সময় ভেসে ওঠে মনে—ওটুকুই পাওয়া। আসলে এই অনুভুতি কি ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যাবে? আর কথা হলো, আমরা যখন কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারি না, তখনই আমরা বলি, আমার এটা ভালো লাগে।’
৩. চলচ্চিত্র
যুদ্ধকালীন অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ধারাভাষ্য
প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম লিখতে গিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো নাম চলে আসছে মাথায়। তবে এই মুহূর্তে আমি বলব প্রিয় চলচ্চিত্র আ বয় ইন দ্য স্ট্রিপ পাজামাস–এর কথা। আইরিশ লেখক জন বইনের গল্প অবলম্বনে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রনির্মাতা মার্ক হেরমান নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ছবিটি ভালো লাগার প্রধান কারণ হলো, সেই অর্থে মারামারি-কাটাকাটি এখানে নেই, কিন্তু যুদ্ধকালীন যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা—সেগুলো পাত্র–পাত্রীদের চেহারায় দারুণভাবে পাওয়া যায়। যুদ্ধকালীন যে গুমোট অবস্থা এবং এর যে প্রভাব, দর্শক হিসেবে আমিও সেটি উপলব্ধি করেছি। এ সিনেমায় যে বিষয়টি আমাকে ছুঁয়ে গেছে, তা হলো আমরা অনেক কিছু ঘটাই—ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিন্তু এই অনেক কিছু ঘটানোর আমাদের ‘রাইট’ নেই; এবং নিয়ন্তা বলে যে একজন আছেন, সে রকম একটা ব্যাপার শেষ দৃশ্যে পাওয়া যায়। নিয়ন্তাই আমাদের শিক্ষা দেন, সবকিছু করা ঠিক নয়, সীমালঙ্ঘন ঠিক নয়।
৪. মঞ্চনাটক
‘তুঘলক’ আর তারিক আনামের দুর্ধর্ষ অভিনয়
প্রিয় মঞ্চনাটক? নাটকটি আমাদেরই দলের, নাট্যকেন্দ্রের। নাটকের নাম তুঘলক। গিরিশ কারনার্ডের লেখা এ নাটকের নির্দেশক তারিক আনাম খান। এটি নাট্যকেন্দ্রের এক অসাধারণ প্রযোজনা। তুঘলককে সবাই ‘পাগলা রাজা’ বলতেন, একই সঙ্গে তুঘলক ছিলেন অনেক আধুনিক। অন্যদের সঙ্গে এক কাতারে মেলানো যাবে না, এমনই একজন শাসক ছিলেন তিনি। তুঘলক নাটকটির কথা মনে পড়লে আমার চোখে আজও ভাসে তারিক আনাম খানের দুর্ধর্ষ অভিনয়। আমি প্রত্যাশা করি, এই অনন্য সাধারণ প্রযোজনাটি আবার মঞ্চে আসুক। না, এখানে আমি অভিনয় করতে চাই না; কেবল দর্শক হিসেবে তুঘলক দেখতে ইচ্ছে করে আবার।
৫. গান
‘আমি তোমার গান তো গাই নি’
অনেক গানের মধ্যে আমার প্রিয় একটি গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’। গানটি মূলত আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এই গানের মধ্যে আমার নিজের ভেতরের কথা, ভেতরের আফসোসের কথা, প্রেমের কথা, তৃষ্ণার কথা—এগুলো আছে। বিশেষ করে ওই লাইনটা, ‘আমি তোমার গান তো গাই নি’—এ গানে আমি আধ্যাত্ম প্রেম খুঁজে পাই, সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাই। তাঁকে অন্বেষণের কথা খুঁজে পাই এবং তাঁকে স্মরণ করতে না পারার আফসোসের কথা খুঁজে পাই।