নিজেদের মধ্যে মারামারি,পুলিশ ও স্থানীয়দের ওপর হামলা— কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এগুলো প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। শনিবার (২১ অক্টোবর) টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া ইয়াবা পাচার, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের অনেকেই। এসব কারণে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।
নতুন-পুরনো মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন ক্যাম্পে এখন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। অথচ উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ইয়াবা, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের মারধরের শিকার যেমন হয়েছেন, তেমনি গত শনিবার এক রোহিঙ্গা দম্পতির মারধরের শিকার হয়েছেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কবির হোসেনও। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার, রোহিঙ্গাদের হাতে রোহিঙ্গা খুন,রোহিঙ্গাদের হামলায় আহত ব্যক্তির মৃত্যুসহ গত দুই মাসে বেশকিছু অপরাধের ঘটনা ঘটিয়েছে রোহিঙ্গারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবাসহ রোহিঙ্গাদের ধরা পড়ার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৬ সেপ্টেম্বর কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গাদের হামলায় রোহিঙ্গা খুন হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের হামলায় উখিয়ার পালংখালী এলাকার মুরগির খামারি জমির উদ্দিন আহত হন। ৭ অক্টোবর কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্প লাগোয় খাল থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৮ অক্টোবর কুতুপালংয়ে ত্রাণের টোকেন বিতরণ করতে গিয়ে মুক্তি নামের এনজিওকর্মী রোহিঙ্গাদের হাত থেকে বাঁচতে গাছে উঠে পড়েন। ১৯ অক্টোবর মহিষ বিক্রিকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা সহোদর ধলাইয়া ও কালাইয়ার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় স্থানীয় আবু সিদ্দিকের। এরপর তারা সিদ্দিককে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে। ২১ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ ২১ অক্টোবর টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে রোহিঙ্গা নারী দিল বাহার ও তার স্বামী সৈয়দ আহমদ অবৈধভাবে একটি মুদির দোকান স্থাপন করার চেষ্টা করেন। এসময় ক্যাম্পে থাকা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কবির আহমদ তাদের বাধা দেন। সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের ওপর হামলা চালায় তারা। এ ঘটনায় ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই কবির আহত হয়। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত শেখ আশরাফুর জামান বলেন, ‘এসআই কবিরের ওপর হামলার ঘটনায় আট জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
ওসি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে পুলিশের দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। আবার সেখানেই হামলার শিকার হতে হচ্ছে পুলিশকে। এর থেকে বড় সমস্যা আর কিছু হতে পারে না।’
উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভারে উখিয়া টেকনাফ জর্জরিত হয়ে গেছে। তাদের জন্য স্থানীয়দের ঘর থেকে বের হওয়া দায় হয়ে গেছে। তারা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডও ঘটাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অবৈধ কার্যক্রমে উখিয়ার সামগ্রিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাদের দমন করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’ ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর কঠোর নজরদারি করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছেন স্থানীয়রা। এরপরও যদি তাদের হামলার শিকার হতে হয়, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তারা যেন কোনও অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটাতে না পারে, সেজন্য পুলিশ কঠোর নজরদারি রেখেছে।’
তবে রোহিঙ্গাদের এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামীতে তা আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।