আজ - মঙ্গলবার, ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ২:৩৩

করোনাকালীন সম্মুখ যোদ্ধা ডিআইজি মনিরুজ্জামান – আক্রান্তের পর করোনা জয়! কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

পাঠকের কলাম : ১৪ জুলাই হঠাৎ শরীরের জ্বর, মাথাব্যথা, সামান্য গলা ব্যথা ও শরীর ব্যথা। মানসিক প্রস্তুতি ছিলই। এর আগেও দুবার করোনা টেস্ট করিয়েছি ফলাফল নেগেটিভ। ছোটবেলায় জ্বরজারি হলে দাদি পড়া পানিতে ফুঁ দিয়ে বলতেন খেয়ে ফেল, টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার,রোদে জলে ঘামে ধুলায় মেশানো শরীর কিচ্ছু হবে না।বলেই দাদি হাসতেন, সামনের দিকের পান খাওয়া দাঁত একটু ফাঁকা ছিল। অদ্ভুত লাগত।

শৈশবে দারুন লাগত দাদীর পানি পড়া, বাড়তি পাওনা ছিল হাতে মাখানো মুড়ির মোয়া কখনো কখনো আট আনা দামের সোনালি হলুদ দু’পর্বের নাগিন বিস্কুট। পানি পড়া আবার খেলেই হবেনা, তারও বিশেষ তরিকা আছে,ফজর ওয়াক্তের পরপরই বামহাতের কবজির উপর পড়া পানির কাসার গ্লাসটি সেট করে ডান হাত দিয়ে ধরে পশ্চিমমুখো হয়ে বসে বিসমিল্লাহ বলে খেতে হবে।তাই করতাম আর উনি বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ পড়তেন,অদ্ভুত সুন্দর একটা সুগন্ধ আসতো তার পানমশলা খাওয়া শরীর থেকে।দোয়াদরুদ বুঝতামনা,গন্ধটা উপভোগ করতাম।

দাদীর পানি পড়ার গুনেই হোক আর রোদে জ্বলা পোড়া শরীরের ইমিউনিটির (এ শব্দে তখন আমি কেন আমার শিক্ষিত বাবা চাচারা জানতো বলেও মনে হয়না) কারণেই হোক সে জ্বর ভাল মত আসার আগেই উধাও। বাড়ী ভর্তি বাতাবি লেবুর গাছ। ছোটবেলা থেকেই ছোট দের কাছে প্রায় অখাদ্য বাতাবি লেবু, কাঁচামরিচ,নুন আর সরষের তেল দিয়ে মাখানো বাতাবি লেবু ছিল জ্জরোরোগীর আবশ্যিক পথ্য।সমবয়সীদের কাছে প্রায় কুখাদ্য হলেও আমার ভালো লাগত। তার কারনটা বলি।

ক্লাস সেভেন পড়ার সময় আমাদের বুরুজবাগান হাইস্কুলের ডাকসাইটে হেডস্যার জনাব শফিউর রহমান(আল্লাহ স্যারকে বেহেশ্ত নসিব করুন) স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম। স্যারের জ্বর হয়েছিল। আমাদের স্কুল থানা সদরেও নয়, বলতে গেলেই গ্রামেই। সেই আমলে তিনি কোট টাই পরতেন। ইংরেজির শিক্ষক, ভীষন চোস্ত ইংরেজি বলতেন, আর ছিলেন অসম্ভব গম্ভীর। গ্রামাঞ্চলে গাম্ভীর্য্য এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্যার এমনিতেই অসম্ভব ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। আমার বাবা তার পাশাপাশি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।ভালছাত্র ছিলাম,ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম,স্যারের দৃষ্টিতে পড়াশোনায় আচরণে ভালো ছিলাম। আর ভয় জিনিসটা ছোটবেলা থেকে আমার ডিকশনারিতে নেই, সম্মানের ভয় ছাড়া। স্যার ক্লাসে যাওয়া মানেই পিনপতন নিস্তব্ধতা। যে কোন কারনেই আমাকে পছন্দ করতেন, কখনো কখনো ঠোঁটের গোড়ায় সামান্য হাসি ও দিতেন আামাকে দেখলে যা ছিল নিতান্তই বিরল।

শিবের গীত বাদ দিই। জ্বর হওয়ায় স্যার কে দেখতে গেলাম। স্কুলের পাশেই স্যারের দ্বিতল বাড়ী। গিয়ে দেখি স্যার কড়ির বাটিতে আয়েশ করে জাম্বুরা খাচ্ছেন। তেল লবন মাখানো। তখন থেকেই আমার মনে হতো এটি ভদ্রলোকের খাবার। কারণ গ্রামদেশে জাম্বুরা আমরা যতটা খেতাম তার চেয়ে বেশি জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম।

যা হোক এত কথা বললাম এজন্য যে, শারীরিক সুস্থতা আল্লাহর বড় নেয়ামত, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দুহাত ভরে সে নেয়ামত দিয়েছেন। এর আগে পরপর দুবার করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসলেও তৃতীয়বারের টেস্টের আগে শরীরে উপসর্গ ছিল। পুলিশ হাসপাতালে যোগাযোগ করলাম। বললো স্যার ইনশাল্লাহ এবারও নেগেটিভ হবে কিন্তু এবারে আর তা হলোনা। ১৫ জুলাই সকাল দশটায় স্যাম্পল দিলাম। আসরের নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই ফোন বাজল, ফোনটি সামনেই ছিল, পুলিশ হাসপাতালের প্রিয় মুখ এডিশনাল এসপি শান্ত খুব শান্তভাবে বলল স্যার অফিসিয়াল রিপোর্ট পাইনি ল্যাব থেকে জানলাম পজিটিভ। তবে ভাইরাসের লোড বেশি না। আমার প্রেসার হালকা করার জন্য ছেলেটি যা যা বলার বলল। ঠান্ডা মাথায় বাকি নামাজ শেষ করলাম। নিজেকে সময় দিলাম।

কারণ বাবা মা মারা যাওয়ার পর স্ত্রীই অনেকটা অভিভাবক হয়ে যান। আমাদের পরিবারের কারো কিছু হলে তিনি যার পর নাই বিচলিত হন,শাপশাপান্ত করেন যাকেই সামনে পান তাকে।,সে সময় তিনি ছোট বাচ্চা ওয়ালা মুরগির মতই ভয়ংকর। প্রথমে ঝাড়লেন আমাকে কেন এত অফিস করি, নিজের জীবনের কোন দাম নেই, আমি না হয় পরের মেয়ে নিজের তো দুটো বাচ্চা আছে তাদের জন্য মায়া নেই, আরো কত কথা!সেসব সাতকাহন বিবাহিত সব পুরুষই জানেন।আমার কাজ চুপচাপ থাকা,জানি রেডিও একসময় থামবেই কান্নাকাটিতে,সে পর্বই ভয়ংকর।তারপর ঝাড়ল অফিসকে। রাত নেই দিন নেই খালি অফিস অভিযান আর অফিস। অফিসের 50-60 জন আক্রান্ত একটু সাবধানে কি অফিস করা যেত না?কেন এত দিল দরিয়া, নিজের জীবনের মায়া নেই,মানুষ নিয়ে মাথাব্যথা।মানুষ না দেখলে ভালো লাগে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরপর যা বাকি ছিল তাহলো মানুষটা এত মানুষের জন্য করে তাকেও কেন আল্লাহ এমন বিপদ দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। 26 বছরের যোগাযোগ,সহযোদ্ধা,ছায়াসংগী।তাকে আমি হাঁড়ে হাঁড়ে চিনি। তার কান্না থামাতে ওভার ডোজ, ওভার ট্রাম দিতে হবে এটা হচ্ছে সিস্টেম।

আমার বাচ্চা দুটো মাশাল্লাহ বাঘের বাচ্চা, বুক ফাঁটবে কিন্তু চোখের পানি সহজে বেরুবেনা। তার দুতিন দিন আগে পুলিশ সুপার মিজান মারা গেছেন। সেই স্মৃতি তাজা। বাচ্চারা না কাঁদলেও বুঝলাম ওরা ভয় পেয়েছে, বুক হিম করা কঠিন ভয়।

বসদের কে ঠান্ডা মাথায় জানালাম। হাসপাতলে বললাম ভাই তোমাদের মেহমান হতে চাই। স্নেহের পুলিশ সুপার এমদাদ ও তার বাহিনী বলল স্যার আমরা সাদরে অভ্যর্থনা জানাবো। এডিশনাল এসপি শান্তকে বললাম কতদিন থাকতে হবে জানিনা একটু আকাশ দেখা যায়, মানুষ দেখা যায় এমন একটা রুম দিও ভাই।মুখে দাড়ি অথচ ভীষণ রোমান্টিক প্রিয়মুখের শান্ত বলল স্যার আপনি আবেগী মানুষ, ঠিক করেছি শুয়ে শুয়েও আকাশ দেখতে পারবেন এমন ব্যবস্হা করছি।

চলে আসলাম হাসপাতালে। বাসায় থাকলে মাগরিবের নামাজ সাধারণত আমার ছেলে আমার সাথেই পড়ে। ঐদিন দরজা দিলাম। ছেলেকে বুঝালাম আমি করোনা পজিটিভ কাজেই তুমি আম্মুর সাথে নামাজ পড়ো। দরজা বন্ধ করে মাগরিব পড়লাম। পরম শ্রদ্ধেয় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ সাহেবের শেখানো মতে তিন রাকাত নামাজের 6 টি সেজদার প্রতিটি মনের মত করে দেয়ার চেষ্টা করলাম,সুস্হ্য অবস্হায় এটাই জীবনের শেষ সেজদা কিনা কে জানে?
হল কিনা জানিনা তবে চোখ ফেটে জল আসলো। বাবা-মা কেউ নেই যাদের কাছে কাঁদা যায়। বাবা শিখিয়েছেন হাত খালি আল্লাহর কাছেই তুলবা বাকিদের কাছে হাত উপুড় করবা অর্থ্যাৎ পারলে কিছু দিবা। দেবার তেমন কিছু নাই তবে চাইনা পারতপক্ষে কারো কাছে কিছু। আল্লাহর কাছে শিফা চাইলাম যতটা না নিজের তার চেয়েও বেশি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য।

করোনা কালের শুরু থেকেই বলতে গেলে আলাদা থাকি, মেয়েটাকে ছুঁই না, ছেলেটাকে হামলে আদর করি না, স্ত্রীর সাথে আলাদা বিছানায় ঘুমাই। আমি জানতাম করোনা আমার হবেই, যেভাবে ছোটাছুটি করি, যেভাবে কাজ করি তাতে করোনা আমার না হওয়ার কোন কোন কারন নেই তা সে যতই মাস্ক বা পিপিই পরিনা কেন।

এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক সহকর্মী মারা গেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার। আমি তো সবসময়েরই ফ্রন্টলাইনার, কাজে আমার না হওয়াটা আশ্চর্য্য। এত দিন যে হয়নি এটাই মাবুদের রহমত।

বড় বিপদে আমার মাথা ঠান্ডা থাকে আল্লাহর রহমতে, মাবুদই করে দেন। কারণ বাবামায়ের মৃত্যুর পর আমিই আমার অভিভাবক। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসা থেকে বের হচ্ছি আর আসতে পারবো কিনা তার গ্যারান্টি কি? মানুষের সাথে আমার আর্থিক দেনা পাওনা কম কিন্তু আমানতদারী তো আছে, টাকা পয়সার আমানত আছে। এখন যদি বউকে ডেকে বলি অমুকের কাছে টাকা পাব বা অমুকে আমার কাছে টাকা পাবে তাহলে তো কান্নাকাটি শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু সে কাজটি করলাম অন্যভাবে। নিকটাত্মীয়দের আমানত আমার কাছে গচ্ছিত আছে। আমি মরে গেলে ওরা হয়তো বলবে না যে আমার কাছে টাকা পায়। হয়তোবা মাফ করে দিবে। মাফ তো একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাই। কার কার কাছে ঋণী, কার কার কাছে টাকা পাবো তার একটা হিসাব করলাম। মোবাইলে ছবি তুলে রাখলাম। যদি অবস্থা খারাপ হয় তো বউকে আরো একটু দায় দিয়ে যাবো। ইসতেকফারের নামাজ পড়লাম সময় নিয়ে। হাসপাতালে চলে আসলাম।

কষ্টের বিষয়টি হচ্ছে কাউকে ছুঁয়েও আসতে পারলাম না, এতটাই অছ্যুত এই রোগ। প্রাণপ্রিয় দুই সন্তান, দীর্ঘ বছরের সহযোদ্ধা স্ত্রী, ব্যক্তিগত স্টাফরা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কাউকে একটু ছুঁয়ে যে দেখবো, নিজের আত্মজাও আত্মজকে একটু যে ধরব সে উপায় নেই। বউ এসে গাড়ির জানালায় মাথা ঠুকছে, ছেলেমেয়েরা ওদের মাকে বুঝাচ্ছে। আমার ওষুধ হচ্ছে ঝাড়ি মারা। ডাবল মাস্কের তলে চোখ মুখ নাক ঠোঁট ভিজে যাচ্ছে নিঃশব্দ কান্নায়। ওদেরকে বললাম খোদা হাফেজ, ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি ছাড়ো।

গাড়ি রমনা কমপ্লেক্সের গেইট পার হলো, ওরা হাত নাড়ছে, আমি চেয়ে আছি জানালায় যতদূর চোখ যায়।কেজানে এটাই জীবিত অবস্হায় শেষ দেখা কিনা?

চোখ মুছলাম। গাড়ির এসি অফ করে জানালা খুলে একটা সিগারেট ধরালাম। ড্রাইভার বলল “স্যার ম্যাডাম শুনলে রাগ করবে।” বললাম বেটা বিয়ে করছনা? বউরা রাগ করেনা এমন কোন ব্যাপার কি আছে? বাসা থেকে পুলিশ হাসপাতাল, একটা সিগারেটই তো খাবো। যা হওয়ার হয়ে গেছে, কি আর হবে? দেই দুটান. তারপর ফেলে দিয়ে গাড়িতেই ওযু করব। করলামও তাই।

হাসি মুখে পুলিশ হাসপাতাল আমাকে রিসিভ করল। ভাবছিলাম করোনা রোগী কেউ কাছে আসবে না। কিসের কি, সিনিয়র পুলিশ অফিসার, ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের স্টাফ ওয়ার্ড বয় আর আমার পূর্বতন কর্মক্ষেত্রে রাজারবাগের শতাধিক সদস্য হাসপাতাল গেটে রিসিভ করল। এডিশনাল এসপি শান্ত রুমে নিয়ে আসলো। রুম দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো। নবসজ্জায় সজ্জিত রাজারবাগ সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালের 10 তলা ভবনের টপ ফ্লুরের সর্ব পূর্বের 30 ফুট বাই 20 ফুট কেবিনটিই আমার আপাতত ঠিকানা। জানালা খুললেই সমগ্র মতিঝিল এলাকা দেখা যায়। চোখ আটকে থাকে হাসপাতালের সামনে ফোয়ারা আর চারপাশের সবুজ লনটিতে। ভাবলাম যদি মারাও যাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার জন্য জায়গাটা মন্দ নয়!

ডাক্তার সাহেব আসলেন। পুলিশের চাকরি করি,সারা জীবন মানুষকে জেরা করেছি, এবার আমার পালা। জেরা শেষে জিজ্ঞেস করলেন,” স্যার কেমন লাগছে?” বললাম ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করছে,ব্যাডমিন্টন বা টেবিল টেনিস ব্যবস্থা করা যাবে?ডাক্তার সাহেবরা সবাই সাদা এপ্রোনে আগাগোড়া মোড়া থাকে। কাউকেই চেনা যায় না। বলল স্যার পুলিশ পারেনা এমন কিছু আছে?ব্যবস্থা হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না। এডিশনাল এসপি শান্তকে বললাম এই রুমে কি আরো খাট ঢুকাতে পারবা? বলল কেন স্যার, আপনি একা মানুষ, দুটো খাট তো আছেই।

আমি তুলা রাশি নই তারপরেও মনের মধ্যে “কু” ডাক দিচ্ছিল। পরদিন বাসার সবাইকে টেস্ট করালাম। সেদিন 16 জুলাই। ডাক্তার সাহেবদের অনুমতি নিয়ে নীচে গেলাম, স্ত্রী-কন্যা, পুত্রদের স্যাম্পল কালেকশন এর জন্য। মোটামুটি ধারণা ছিল স্ত্রীর পজেটিভ হতে পারে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি অধিকাংশ কাজ নিজেই করতাম। নিজের থালাবাটি, কাপড় চোপড়, রুম পরিস্কার। তারপরও উনি রুমে এসেছেন, মানা করা সত্ত্বেও আমার খাটে বসেছেন। তার হলে হতে পারে এ আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বাঁচ্চাদের যে হবেএটা একবারের জন্যও ভাবিনি। আমার সকল আশা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে 16 তারিখ বাদ আসর রিপোর্ট পেলাম। স্ত্রী যদিওনেগেটিভ, বাচ্চাদুটো পজেটিভ।

সময় নিলাম, ঠান্ডামাথায় এনালাইসিস করলাম।পরিচিত নির্ভরযোগ্য ডাক্তার সাহেবদের সাথে কথা বললাম। দুধরনের পরামর্শই পেলাম। কেউ বলে বাচ্চাদের কিছু হবেনা, বাসায় থাক। কেউ বলে আপনাদের হাসপাতালের করোনা চিকিৎসার রেপুটেশন ভালো। হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারেন। সবাই একসাথে ভালো থাকবেন। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমার সময় লাগে না। সিদ্ধান্ত নিলাম বাচ্চাদের কে আমার কাছে নিয়ে আসবো। রুমে এক্সটা খাট দিতে বললাম। সমস্যা হল স্ত্রীতো নেগেটিভ, বাসায় যে খালা আমাদের সহযোগিতা করেন, তিনিও পজিটিভ। খালাতো শুনেই কেঁদে আকাশ ভেঙ্গে ফেলছেন। করারই কথা,সংসার সন্তান ফেলে এসেছেন দুটো পয়সার আশায়,হঠাৎ কি বিপত্তি!!তার কাছে আজ করোনা মানেই কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু। তাকে বুঝালাম। হাসপাতালে ভর্তি করালাম।

স্ত্রীকে বুঝলাম সরকারি কোয়ার্টার সিকিউরড তুমি বাসায় থাকো। তিনি তো আমাদের চেয়েও একধাপ এগিয়ে বললেন তোমাকে, বাচ্চাদেরকে হাসপাতালে রেখে আমি বাসায় থাকব? মরে গেলেও না। মরলে মরব।তোমাদের কিছু হলে আমার বেঁচে থাকার দরকারই বা কি?আমি বললাম দরকার আছে।আমার মা একটা কথা বলতেন “বাপ চাচারা সাত ভাই,বাপ মরলে কেউ নাই”।
বললাম তুমি বাসায় থাকলে আমাদের খাওয়া-দাওয়া কত কি সুবিধা হবে তুমি যেহেতু নেগেটিভ, তিনবার সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে স্টে এট হোম। ও বলল ঝ্যাঁটা মারি স্টে এট হোমের,৪ মাস তো থেকে দেখলাম!!। আমি তাকে চিনি। দেখতে সোজাসরল কিন্তু মারাত্মক ঘাড়ত্যাড়া।তাকে আপাতত অন্য কিছু বোঝানো যাবে না।

আমাদের কলিগদের কয়েকজনের সাথে কথা বললাম যারা হাসবেন্ড ওয়াইফ এর একজন পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে এসেছেন অন্যজন নেগেটিভ হয়ে এসেছেন আবার নেগেটিভ হয়েই ফিরে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বললাম। বললেন উনার রিস্ক তো আছেই,তবে হবেই যে এমনটি নিশ্চিত নয়।

তবে মাস্ক পরে প্রোটেকশন নিয়ে থাকতে হবে। আর ঘাটালাম না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হাসপাতালের কেবিনটিকে রিশেপ করলাম। কেবিনটির একপাশে ১০ ফুট বাই ৯ফুট ডাইনিং স্পেস আছে। ওটাকে একটু পর্দা দিয়ে ঘিরে ওয়াইফের ব্যবস্থা করলাম, আর আমরা তিন রোগী একসাথে।

ছেলে এবং মেয়ে যথারীতি জানালার পাশে সিট নিয়ে ঝগড়া বাধালো। পরবর্তীতে বাবার পাশের সিটে থাকতে পারবে, বিছানায় শুয়েও মাকে দেখতে পাবে এই প্রলোভনে ছেলে তার বোনকে জানালার পাশের সিটটি ছাড়তে রাজি হলো।শর্ত হল আইপ্যাডের মাতবারিটা তার থাকবে।

দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ, বাচ্চাদের সবারই স্টাডি গ্রুপ আছে। স্বল্পতম সময়ে ওরা ওদের ফ্রেন্ডদের জানালো “জানো আমাদের সবার করোনা হয়েছে।” যেন বিরাট একটা অর্জন ওদের। আশ্চর্যের বিষয় হাসপাতালে সবই ওদের ভালো লাগে। কারণ দুজনকে দুইটা ডিভাইস দেওয়া হয়েছে এবং জীবনে এই প্রথম কেউ ওদের বলছে না মোবাইল রাখ, আইপ্যাড রাখো ইত্যাদি ইত্যাদি।সকাল ১০ টা পর্যন্ত ঘুমালেও সমস্যা নেই বরংবাবা মা খুশি,ডাক্তার বলেছে রেস্ট দরকার।তারপর যখন ডক্টরদের সাথে কথা বলে জেনেছে ওদের কোন ইনজেকশন দিবেনা পারলে তো ওরা তখনি পার্টি করে!

আরো মজার বিষয় মেয়েটি জীবনে এই প্রথম ধুমসে পড়াশোনা শুরু করলো, হয়তো টেনশন কাটানোর জন্যই।ওর মা প্রায়ই বলতো তোর একটু পড়াশোনায় মনোযোগ আসলে মরেও শান্তি পেতাম। মেয়ের পড়াশোনার মনোযোগ দেখে ওর মা বলা শুরু করলো আমি মনে হয় বাঁচবো না। বললাম কেন তুমি নেগেটিভ আমরা পজিটিভ তুমি কেন মরবে। ও বলল বড় সাধ ছিল মরার আগে যেন প্রিয়ন্তীকে পড়াশোনায় মনোযোগী দেখতে পাই। আল্লাহ যেহেতু তা কবুল করেছেন কাজেই সময় ফুরিয়ে এসেছে। লে ঠ্যালা,আজব এক সৃষ্টি এই নারীজাতি।

মেয়েকে বললাম “মা জননী,কাহিনী কি? ও
বললো সিম্পল,কেউ যেন আমাকে আহা,উহু না করে, সময় ভালো কাটে। আম্মু খুশি হয় কাজেই পড়াশোনা করি।

হাসপাতালে ওদের সব ভাল লাগা শুরু হল। শুধু আদা লেবু লং হাবিজাবি বহু রকমের অখাদ্য দিয়ে গার্গল করা এমনকি তা খেয়ে ফেলা ছাড়া। আমি বলতে গেলে সর্বভুক পর্যায়ের মানুষ। তাও আমার সহ্য হয় না সে অখাদ্য। বাচ্চারা তো করতেই চায়না।

ওরাও দারুন স্মার্ট, মুখে কিছু বলেনা গরম পানির গ্লাস নিয়ে বাথরুমে যায় শব্দ করে গড়গড় করে কিন্তু পানিটা ফেলে দেয় বেসিনে। কৃত্রিম বিরক্ত মুখ নিয়ে বাইরে এসে বলে আম্মু আর কতবার করাবে? তারপর দুজনে ইশারায় হাসে। আমি তো পুলিশ, পুলিশের বাচ্চারাও আমার কাছে ধরা পরল, বলল আব্বু ভালো লাগে না। পরে ওদের জন্য আদা লেবু বাদ দিয়ে লবণ আর গরম পানির ভাপ এর ব্যবস্থা করলাম মোটামুটি করা শুরু করল। ছেলেটা সে তুলনায় অনেক সিনসিয়ার। মা মনে কষ্ট পেতে পারে না করলে এই চিন্তায় সে গড়গড়া, ভাপ নেয়া থেকে শুরু করে যা যা করার তার সবই করল।

ভালোই ছিলাম একসাথে।
প্রতিদিন রাত জেগে গান শুনতাম যার যার পছন্দের। আমরা তো একটু সেকেলে। আমি আর বউ শুনতাম রবীন্দ্র সংগীত, বাংলা গান। মেয়ে শোনে মূলত ইংরেজি গান, শুনতে শুনতে ভালো লাগা শুরু হল ওর গানগুলোও। ওরা আবার এক্সসেন্ট ভালো বুঝে। আমাদের তো লিরিক্স লাগে। ওরা বুঝিয়ে দেয়। ভালই কাঁটতে থাকে দিন।

এর মধ্যে আসতে থাকে একের পর এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। নিকটজ্বনের মৃত্যু, মৃত্যু আশংকা, কত কিছু। সবকিছু ছাপিয়ে যায় লক্ষ মানুষের ভালোবাসায়। শুরু থেকেই আমাদের অসুস্থতা গোপন রাখার পক্ষে ছিলাম অন্তত ভার্চুয়াল জগতে। কারণটা পরিষ্কার। আমার স্ত্রী তার বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। আমার শ্বশুর প্রাকটিক্যাল পোড় খাওয়া মানুষ, আবেগ-অনুভূতি কম। শাশুড়ি ঠিক তার উল্টো। অনেক দিন ধরে আমার শ্বশুর তার মেয়েকে এবং নাতিপুতিদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ইনস্টিগেট করেছে। উনার ধারণা উনার বয়সী প্রায় সবাই মারা গেছেন, উনার সময়ও ফুরিয়ে আসছে।

মেয়েটার এসএসসির অনেক আগে থেকেই আমরা মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম গ্রামের ববাড়ি যাব।করোনার কারনে হয়নি।সর্বশেষ সিদ্ধান্ত যে, ঈদের পরপরই বাড়িতে যাবো। প্রস্ততি,কেনাকাটা,ব্যাগগোছা,কাজিনদের সারপ্রাইজ দদেবার প্রস্ততি সবই শুরু হয়েছে পুরো দমে। হঠাৎ এই মমাথায় আকাশ ভেঙে পড়া।আমাদের পুরো পরিবারের এই ডিজাস্টার শুনলে উনারা সহ্য নাও করতে পারেন এ কারণে আমার এক ভাই, আমার স্ত্রীর এক ভাই, ঢাকাতে আমার মামা বিগ্রেডিয়ার মাহফুজ, অফিসের কলিগদের কয়েকজন ছাড়া কাউকে জানাইনি।

সৌদী প্রবাসী এক ছোট ভাই মসজিদে নববীতে গেলেই আমাকে ভিডিও কল দিয়ে বলে স্যার নবীজির রওজায় সালাম দেন। সালাম দিলাম এবং তাকে বললাম ভাই আমরা সবাই তো অসুস্থ আমাদের জন্য দোয়া করো।
সে ফেসবুকে সকলের দোয়া চেয়ে একটা স্ট্যাটাস দিল, তারপর তো ইতিহাস। সে কথা অন্য একদিন বলবো। যেটি না বললেই নয় সেটি হচ্ছে অনেক ঋণী হয়ে গেলাম অনেকের কাছে।

সাধারণ ভদ্রতার অংশ হিসাবে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,আইনমন্ত্রী, অন্যান্য কয়েকজন মাননীয় মন্ত্রী, আইজিপি স্যার, সচিব স্যার,প্রাক্তন আইজিপি জনাব একেএম শহীদুল হক স্যার, ডঃ জাভেদ পাটোয়ারি স্যার,নুরুল হুদা স্যার, বাংলাদেশ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ,আমার ইউনিটের চিফ কামরুল স্যার,ডিআইজি দিদার স্যার,আমার দীর্ঘ সময়েরপূর্বতন বস ডিএমপি কমিশনার শফিক স্যার,এসবি চীফ মীর শহীদ স্যার,এডিশনাল আইজি কোরেশী স্যার,রুহুল আমীন স্যার, সিটিটিসির মনির স্যার,ডিআইজি হাবিব স্যারএবং সবসময়ই যারা খোঁজ-খবর নেন এমন কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্যদের কাছে এবং বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন দের কাছে দোয়া চেয়েছি হাসপাতালে আসার আগে।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, এলজিআর প্রতিমন্ত্রী, আমাদের বর্তমান ও প্রাক্তন সাংসদ, যশোরের ও ব্রাহ্মন বাড়িয়া সহ সারা দেশের অর্ধশতাধিক সাংসদ বৃন্দ, যেভাবে প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়েছেন, খাবার পাঠিয়েছেন শুভেচ্ছা ও সাহস দিয়েছেন তা কোনদিন ভুলবোনা।
বিশেষ করে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,মাননীয় আইনমন্ত্রী,মাননীয় এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী প্রতিনিয়ত খবর নিয়েছেন,সাহস যুগিয়েছেন।
আইজিপি মহোদয়, প্রাক্তন আইজিপি শহীদ স্যার,জাভেদ পাটোয়ারী স্যার প্রায়ই ফোন করে খবর নিয়েছেন দোয়া করেছেন,পরামর্শ আর সা্হস দিয়েছেন।উনাদের কাছে ঋণের শেষ নেই।

প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষা সচিব সোহরাব স্যার প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় খোজখবর নিয়েছেন।মাননীয় কয়েকজন সচিব,উর্দ্ধতন সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ,সরকারের অতিরিক্ত সচিব,যুগ্মসচিবদের কয়েকজন,সরকারী কর্মকর্তাদের ক্লাব অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি মেজবা স্যার,প্রাক্তন সেক্রেটারি ইব্রাহিম স্যার ও ভাবি,আমার এডিশনাল আইজিপি মহোদয়, ডিএমপি কমিশনার, এ্যাডিশনাল আইজিপি, এসবি স্যার ফাইন্যান্স স্যার এইচআরএম স্যার,এডিশনাল কমিশনার সিটিটিসি মনির স্যার,সিএমপি কমিশনার মাহবুব স্যার, ডিআইজি ঢাকা হাবিব স্যার অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ যেভাবে আমার এই দুঃসময়ে আমার ও আমার পরিবারের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন সারাজীবন সেই ঋণ শোধ করতে পারব না।

মনির স্যার সাহস দিয়ে বললেন হাসপাতালে যান,কয়েকদিন একটু রেস্ট করেন আপনার কিচ্ছু হবেনা ইনশাল্লাহ।।হাবিব স্যার যা করেছেন আমার আপন বড়ভাই ও তা করতো কিনা সন্দেহ।হাসপাতালে রুমে ঢোকার আগেই রোগীর যাযা লাগে সব রেডি।জিজ্ঞেস করলাম কে পাঠাল, বলল হাবিব স্যার পাঠিয়েছেন।ভাবি বলতে গেলে আমার বোনই।আমি কি খেতে পছন্দ করি সবকিছু অন্যদের কাছ থেকে জেনে খাবার পাঠিয়েছেন নিয়মিত।খালাম্মা ফোন করে বলেছেন বাবা তুমি আমাদের এলাকার গর্ব,তোমার মা নেই,আমি জায়নামাজে বসলাম।

আমার ব্যাচম্যাট আখতার ভাই,মাসুদ ভাই, বারি ভাই,ইমাম ভাই,আমেনা আপা, হায়দার ভাই,নাজমুল ভাই,শিপার ভাই,মাহবুব ভাই ফাইন্যান্স,আতিকা আপা,মোজাম্মেল ভাই,রেজা ভাই,মুনিবুর,পরিতোষদা, জয়দেব দা, বাসুদা,জিয়াভাই, রউফ,আসাদ ভাই,মাহবুব ভাই(জহুরী), শফিক,শামীমা, সালমা, ফারহাত ভাই সহ অন্যান্যরা নিত্য খোঁজ নিয়েছেন, আমার ও পরিবারের। ভাবিদেরকেও গভীর শ্রদ্ধা।
প্রিয় ভাই,বন্ধু ব্যাচমেট মিজান ভাই ও পাশের কেবিনে শুয়ে আছেন,তার,তার শিশু কন্যার জন্য অশেষ দোয়া।

এটিইউতে আমার সহকর্মী বিশেষ করে ডিআইজি স্যার, এসপি এডমিন সহ অন্যান্যরা প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়েছেন। সারা দেশের হাজার হাজার হাজার সহকর্মী প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিয়েছেন, দোয়া জানিয়েছেন। সকলের কাছে আমার অনেক ঋণ। আমার স্ত্রীর সহ কর্মীদের কাছেও ঋণী।

বিশ্বজুড়ে প্রবাসীদের কাছে ঋন অনেক।সারাবিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে দোয়া বা মিলাদ হয়েছে।মসজিদে নববীতে বাদআছর প্রতিদিন দোয়া করেন সুহৃদরা।আমার স্কুল, কলেজ,আমার এলাকার অর্ধশতাধিক মসজিদ বা এতিমখানায় দোয়া কোরান খতম হয়েছে।ব্রাহ্মণ বাড়িয়া বড় মসজিদ সহ অনেক মসজিদে দোয়া হয়েছে।আমাদের মাননীয় সাংসদ শ্রদ্ধেয় জেনারেল নাসির স্যার,প্রাক্তন সাংসদ মনির ভাই, যশোর জেলা পুলিশ সুপার স্নেহের আশরাফ,নিজে করোনা আক্রান্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় পিকুল ভাই,যশোর জেলা আওয়ামীগ প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধেয় মিলন ভাইও তার সহকর্মীরা, আমাদের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ভাই, ভাইসচেয়ারম্যান স্নেহের ছোটভাই সেলিম সহ স্হানীয় নেতৃবৃন্দ,আলেম ওলামা,আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ,জাতীয় ও যশোরের স্হানীয় সাংবাদিকবৃন্দ,সর্বস্তনের সুধীজন,ঢাকাস্হ যশোর জেলা সমিতির সম্মানিত সভাপতি প্রফেসর রশিদ,সহসভাপতি অতিরিক্ত সসচিব বিকর্ণ দাদা,সেক্রেটারি প্রিয় লুৎফর ভাই,অন্যান্য সভ্যবৃন্দ প্রতিদিনই খোজখবর নিচ্ছেন।

জুম বাংলাদেশের পথশিশুরা কোরান খতম,দোয়া মিলাদ,দরিদ্র ভোজনের আয়োজন করেছেন।সালেহা কবীর জীবন ফাউন্ডেশন এবং আমার আত্মীয় বন্ধুরা দেশে বিদেশে নানা ভাবে দোয়ার আয়োজন করেছেন।পুলিশ হাসপাতাল রেসট্রিকটেড জায়গা,তারপরও এ কয়দিনে কয়েকটন ফল নাম নাজানা সুহৃদরা গেটে দিয়ে গেছেন।ওয়ার্ডবয়,ক্লিনারদের দিয়ে শেষ হয়নি এতিমখানায় পথশিশুদের জন্য পাঠানো লেগেছে।

আমার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের উষ্ণতায় একবারও মনে হতাশা আসেনি।
ব্যাচমেট এবং বন্ধুদের অনেকেই বাচ্চাদের জন্য পিজা চকলেট সহ ওদের পছন্দের খাবার পাঠিয়েছেন।ব্যাচমেট আসাদ,আকতার,জয়দেব,মোজাম্মেল ভাই,রেজা ভাই,রউফ,জিয়াভাইয়ের ভালবাসা আমাকে উষ্ণ রেখেছে।সারাদেশের উদ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ১৮ বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের বন্ধুরা নিত্য সাহস যোগাচ্ছেন।

আমার চীফ এবং ডিআইজি দিদার স্যার প্রতিবেলায় খেতে গিয়েই মনে হয় স্মরন করেছেন।আমাদের এসপি এডমিন হাবিবের একটাই কথা স্যার কি লাগবে একটু বলেন।আমি বলতাম দোয়া।কার কথা বাদ দিব।সবার কাছে ঋনী হয়ে গেলাম।

আমার পারসোনাল স্টাফরা আমার মতই বেবোধ,করোনাকে ওরা থোড়াই কেয়ার করে।প্রতিদিন মানা করা স্বত্বেয় হাসপাতালেআসে,রুমে ঢোকে,ঝাড়ি খায় আমার, হাসে, বারবার আসে,প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে।

আত্মীয় স্বজন, বন্ধু আর পুলিশ হাসপাতালের কথা আরেকদিন লিখব যদি বেঁচে থাকি।

ডিআইজি ডঃ হাসান উল হায়দার স্যার,ডাইরেক্টর সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতাল একজন পরম শ্রদ্ধেয় লিভিং লিজেন্ড,তেমনি তার সহকর্মীরা।বদলে দিতে জানতে হয়,উনি সেটা করে দেখিয়েছেন।এখান ডক্টর,নার্স অন্যান্য স্টাফরা অতুলনীয়।তাদের কথা আরেকদিন লিখবো যদি বাঁচি।

আবার অনেকে আছেন যারা নিজেদের গুরুদায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত আছেন, হয়তো খোঁজ নিতে পারেননি, আশা করি দোয়া করেছেন। তাদের কাছেও ঋণী। খুব অল্পসংখ্যক (প্রিয়জন অন্তত আমি ভাবি) কোন রকম ভন্ডামি না করে আমার মৃত্যু শয্যায়ও আমার বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, তাদের কাছেও ঋণী। তারা আমাকে তাদের কে জানার বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাদের কাছে যদি আমার জানা অজানা কোন দায় থাকে তাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। এবং কোন দায় না থাকলে আমি প্রিয়জন মনে করি অথচ যারা এত বড় দুর্বিপাকেও আমার নাহোক আমার মাসুম বাচ্চাদেরও খোঁজ নেননি বা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তারা দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।হয়তো জানা বা অজানা কোন কারনে আমি আপনাদের কষ্টের কারন হয়েছি।আমি অসুস্থ।আমি আপনাদের সকলের মঙ্গল কামনা করি,কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে,কারো ক্ষতির কারন হয়ে থাকলে ক্ষমা চাই। অসুস্থ মানুষের দোয়া কবুল হয়। মহান রব আমার বন্ধু, সমালোচক, এমনকি আমাকে যারা অপছন্দ বা ঈর্ষা করেন তাদের সকলের মঙ্গল করুন।

আমার অনেক দোষের মধ্যে একটা গুন চর্চা করি,সেটা হচ্ছে কারো বোঝা না হতে চাওয়া।

কবি ইকবালের একটা লাইন বলে আপনাদের বিরক্তির আজকের মত যবর্নিকাপাত করি।

” গুস্তাখি ম্যায় স্রিফ করেঙ্গে একবার
যব সব পায়দল চলেংগে,
ম্যায় চলেঙ্গে কান্ধেপর”

জীবনে গুস্তাখি বা বেয়াদবি একবারই করব যখন সবাই আমার অন্তিম যাত্রায় পায়ে হেঁটে কবরস্হানে যাবে আমি তখন অন্যদের কাঁধে লাশ হয়ে যাব।

আমার মা কায়মনোবাক্যে একটা প্রার্থণা করতেন” হে আল্লাহ ঈমানের সাথে হাতে রথে যেন মরি”

মা পুণ্যবতী ভাগ্যবতী ছিলেন।আমার সাথে এক টেবিলে দুপুরের খাবার খাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে হঠাৎ অসুস্হ্য হয়ে আমার কোলে পা আর আমার স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে পশ্চিম দিকে মুখটা ফিরিয়ে রবের কাছে গিয়েছেন।রা্ব্বুল আলামিন আমার মায়ের আশা পূরণ করেছিলেন।

আমি পাপীতাপী বান্দা,আমার স্বপ্নও তাই।ঈমানের সাথে যেতে চাই, কারো বোঝা কষ্ট বা কারো অনুগ্রহের পাত্র হিসাবে নয়।

আমার মাবুদ আমার সকল আশাই পূরণ করেছেন।তিনি পরম দয়ালু।

আমি আল্লাহর রহমতে সুস্হ্য আছি।আমি ফুটবলার নই কিন্তু কেন যেন ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করছে।খেলেও ফেলেছি গতকাল ছেলের সাথে আমাদের এই পান্হশালায়।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল,ঢাকা
০২ আগষ্ট ২০২০

(চলবে)…

আরো সংবাদ