আজ - বৃহস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সন্ধ্যা ৭:০২

ইইউবি সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোষাধক্ষ্য- চলছে অনিয়ম, অসহায় ইউজিসি!

বিশেষ প্রতিনিধঃ দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকারে পৌঁছেছে। ২৫টিতে নেই উপাচার্য। ৬৩টিতে নেই সহ-উপাচার্য। আর ৪৮টিতে নেই কোষাধ্যক্ষ। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা লেগেই রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, কোথাও বিবদমান মালিকরা বিভক্ত হয়ে আলাদা ক্যাম্পাস গড়ে তুলে শিক্ষাবাণিজ্য করছেন, আবার কোথাও মূল মালিককে একেবারেই বের করে দেওয়া হয়েছে। ‘শিক্ষা ব্যবসায়ীদের’ এমন কর্মকাণ্ডে লাখ লাখ শিক্ষার্থী দিশাহারা। তারা বুঝতে পারছেন না কোন ক্যাম্পাস বৈধ আর কোনটি অবৈধ। ফলে অনেক টাকা খরচ করে লেখাপড়া শেষে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। অর্জিত সনদ তাদের কর্মজীবনে কাজে আসছে না। এমনকি অনেকে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করছেন।

জানা গেছে, বিবদমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দিয়েও সফল হয়নি। মালিকরা বিষয়টি আমলে নেননি। বরং তারা অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে হাত করে নিজেদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেউ প্রতারণা করুক তা চাই না। এ ধরনের কাজ যারা করবে তারা কেউই রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ক্যাম্পাস নিয়ে মালিকানার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। তবে সম্প্রতি সরকারের চাপে একাধিক ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছে অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কমপক্ষে পাঁচটি পক্ষ রয়েছে, যারা নিজেদের ‘প্রকৃত মালিক’ দাবি করে ক্যাম্পাস চালাচ্ছেন। ঢাকার বাইরেও তাদের শত শত ক্যাম্পাস রয়েছে। এ ছাড়া প্রাইম ইউনিভার্সিটির উত্তরা ক্যাম্পাসের সঙ্গে মিরপুর ক্যাম্পাসের দ্বন্দ্ব চলছে। সূত্র আরও জানায়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ট্রাস্টি বোর্ড এবং সিন্ডিকেট থাকার বিধান নেই। কিন্তু উলি্লখিত দুটিসহ দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশসহ অন্যদের একাধিক ট্রাস্টি বোর্ড এবং সিন্ডিকেট রয়েছে। স্বার্থের দ্বন্দ্বে মালিকরা বিভক্ত হয়ে আলাদা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। জানা যায়, ইবাইস ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া লিংকন। তিনি ২০০২ সালের ৬ আগস্ট সরকার থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে ধানমন্ডিতে অস্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি জোরপূর্বক দখলে নেন কাওসার হোসেন কমেট। তার সঙ্গে দেশের একজন শিল্পপতির ছেলেও যুক্ত হন। এরপর উভয় পক্ষে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি মামলা। তবে সর্বশেষ গত বছরের ৪ জুন সর্বোচ্চ আদালত ইবাইস ইউনিভার্সিটির একমাত্র রাজধানীর মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির ক্যাম্পাসকে বৈধতা দেন। এতে প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির ক্যাম্পাস বন্ধ করার কথা থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এ একই পরিণতি হয়েছে বহু বিতর্কিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রেও। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক উপাচার্য আবুল হাসান মো. সাদেকের ভাই দখলে নেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষে টানাপড়েন চলছে। এদিকে অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহাম্মেদের স্ত্রী অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমের নামে অনুমোদন রয়েছে। ২০১১ সালের শেষের দিকে এর একাধিক ক্যাম্পাস দখল নিয়ে অন্য পক্ষ শিক্ষাবাণিজ্য শুরু করে। ওই বিরোধ আজও নিষ্পত্তি হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চারটি ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে একটি করা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও রাজধানীর পান্থপথ, মিরপুর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ক্যাম্পাস খোলার অভিযোগ রয়েছে।

উপাচার্য ছাড়া ২৫টি, কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৮টিতে : ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, ৬৩টিতে সহ-উপাচার্য ও ৪৮টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ অপরিহার্য বলে বিবেচিত হলেও আইনের ফাঁকফোকরে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রস্তাবিত তিনটি নামের মধ্যে আচার্য ও রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেন। উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ এই তিনটি পদের বেলায় একই নিয়ম প্রযোজ্য।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সূত্রমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকা আরেকটি বড় সমস্যা। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের অনেকে এখনো মালিক ভেবে বাণিজ্যিক চিন্তা নিয়ে কাজ করছেন। তারা মনে করেন, কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চললেই হলো, এ জন্যই আজ এমন চিত্র। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিয়মিত উপাচার্য না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয় ও সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি। উপাচার্য না থাকা এই ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের নিয়োগ করা কোষাধ্যক্ষও নেই। এ ছাড়া ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটিসহ নতুন আরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। কোষাধ্যক্ষ না থাকা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি, দ্য মিলিনিয়াম, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি,

ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কিছুদিন আগে যৌথসভা করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই, সেগুলোতে দ্রুত নিয়োগ সম্পন্নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মাধ্যমে ওইসব পদে নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে ইউজিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য আতফুল হাই শিবলী বলেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ তিন পদে সরকার-নিযুক্ত কেউ নেই, সেগুলোকে চিঠি দিয়ে অবস্থান জানাতে বলা হয়েছে। কে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, কে পাঠায়নি সব বিস্তারিত জানাতে বলা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হবে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ওইসব পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান শামীম হায়দার পাটোয়ারী জানান, উপাচার্য নিয়োগের জন্য তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির রেজিস্ট্রার শামস-উদ-দোহা বলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ তিন পদে নিয়োগের জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের মতো পদ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বেশি দিন চলতে পারে না। এটা আইনের পরিপন্থী।

আরো সংবাদ