আজ - রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - দুপুর ১:৪০

উপ সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের সুযোগ-সুবিধা

‘উপ সম্পাদকের কার্যালয় বগুড়া’

পৃথিবীর অনেক দেশে সংবিধান রচিত হয়েছে গোল টেবিল বৈঠকে বসে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে ৩০ লক্ষ নর-নারীদের রক্ত, ২ লক্ষ ৬০ হাজার নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে। জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতি সংঘের সনদের যে চেতনা ১৯৭২ সালের সংবিধানে তা লিখিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব প্রথম শ্রেণির সংবিধান হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন। নারীদের রক্ত নারীদের সম্ভ্রম নারীদের ত্যাগের কথা চিন্তা করে সংবিধানে ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনে সর্বপ্রথম মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি করায় বিশ্বে আমাদের সংবিধান আরও প্রশংসিত হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, জাতীয় সংসদের স্পীকার নারী, বেশ কয়েকজন নারী মন্ত্রি, সুপ্রিম কোর্টের আপীল ডিভিশনের নারী বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নারী, ডিসি, এসপি, সচিব সেনা অফিসার নারী হওয়ায় বিশ্বে বাংলাদেশের সংবিধানকে মডেল সংবিধান বলা হচ্ছে।  বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যে অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে যা বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রের সংবিধানে দেওয়া হয়নি। নারীদের পিছনে ফেলে কোনো জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্র এগোতে পারে না। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ জন ব্যক্তি এই সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। একজন বিরোধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং নারী সদস্য বেগম রাজিয়া বানু এই সংবিধান রচনায় ছিলেন। আমাদের সংবিধানে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা ও সুযোগের সমতা করার কথা বলা হয়েছে- আবার ২৭নং অনুচ্ছেদে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলা হয়েছে। এ জন্য নারীরা বাদী হয়ে মামলা মোকর্দ্দমা দায়ের করতে পারেন। আবার নারীরা আসামী হলে পুরুষের চেয়ে জামিনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য বেশি পায় মর্মে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সরকারি নিয়োগ লাভের সমতা দেওয়া হয়েছে নারীদেরকে। এ জন্য বিসিএস বা পিএসসি সহ সকল সরকারি চাকরিতে সমতা থাকায় নারীরা ভাল ভাল প্রশাসনে নিয়োগ পাচ্ছেন, কোন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না। বরং মহিলাদের জন্য সরকার  অতিরিক্ত নীতিমালা গ্রহণ করায় বাংলাদেশ দিন দিন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সংবিধানের আলোকে বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকার মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নানাবিধ কর্মকান্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণের পথ সুপ্রশস্ত হয়েছে। নির্যাতিত মহিলাদের আইনগত সহযোগিতা দান, এসিড দগ্ধ মহিলা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ ও বয়স্ক মহিলাদের ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যাহা সংবিধানে মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়ের কথা বলা থাকায় তা পূরণ করা হয়েছে। নারীদের কল্যাণের ও অধিকার রক্ষার জন্য আরও অধিক সংখ্যায় রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারি দপ্তরে পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা সহ পৃথক ৩২ বছর বয়স সীমা নির্ধারণ করেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০% শিক্ষক পদে নারীদের পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে (গেজেটেড) পদে ১০% এবং অঘোষিত (নন-গেজেটেড) পদে ১৫% পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে নারীদের জন্য।

বর্তমান সরকার সংবিধানে মৌলিক অধিকার শিক্ষায় নারী শিক্ষা সম্প্রসারনের জন্য মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে, বিনা পয়সায় বই বিতরণ ও লেখাপড়ার সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছে। কলেজ পড়ূয়া ছাত্রীদের ১০০ ভাগ উপবৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে।
চাকরিজীবী মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষ এবং মহিলাদের বেলায় একই বিধান প্রযোজ্য হলেও বেসরকারি খাতে মহিলা চাকরিজীবীদের সংখ্যা অধিক করা হয়েছে। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ১০৯ ধারায় বলা হয়েছে কোন মহিলা শ্রমিককে তার বিনা অনুমতিতে কোন প্রতিষ্ঠানে রাত ১০টা হতে ভোর ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে নিরোধ করা হয়েছে। একই আইনের ৪৬ ধারায় শ্রমজীবি মহিলাদের জন্য পূর্ণ বেতনে প্রসূতি ছুটির সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও সন্তান প্রসবের পূর্ববতী ৮ সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের পরবর্তী ৮ সপ্তাহ প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবার অধিকারী হবেন। যদি মালিক এই আইন না মানেন তাহলে ২৮৬ ধারা মত অনুর্ধ্ব ৫০০০/- টাকার অর্থ দন্ডের বিধান করা হয়েছে।

সরকারি কর্মজীবি মহিলাদের বেলায় প্রসূতি ছুটির আবেদনের প্রেক্ষিতে পূর্ণ বেতনে ৬ মাস ছুটি মঞ্জুরের কথা বলা হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই থেকে মৃত সরকারি চাকরিজীবিদের বিধবা স্ত্রীগণের আজীবন পেনশন লাভের সৃষ্টি করেছেন।  বাংলাদেশের সংবিধানের  ৬৫ অনুচ্ছেদ মত ৩ শত আসনেই নারীরা এমপি প্রার্থী হতে পারবে। তা ছাড়া ৬৫ (সি) ধারা মতে ৫০ জন সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হতে পারেন। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য আইনে নারীদের অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে নারীদের সুযোগ সুবিধা এবং অন্যান্য আইন যেমন বিবাহ সংক্রান্ত আইন, অভিভাবক ও তত্ত্বাবধান আইন, নারীর উত্তরাধিকার আইন, বিক্রি, দান বা হেবা ও উইল আইন, দ  বিধি আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, নারী নির্যাতন দমন আইন, শিশু আইন, এসিড অপরাধ দমন আইন, পারিবারিক আদালত আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, জাতীয় নারী উন্নয়ন প্রভৃতি আইন শুধু নারীদের সুযোগ সুবিধার জন্য করা হয়েছে। এই আইন সমূহ পাঠদান করে বিশ্ব নারী সমাজ বাংলাদেশের জন্য প্রতিনিয়ত প্রশংসা করেছে। এ জন্য গত ইং ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা গেলে আমেরিকার জন সংখ্যায় বৃহৎ রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ছাত্রীরা শেখ হাসিনার প্রশংসা করে যে বাণী পত্র পড়েছিল তাতে লেখা আমাদের আমেরিকা নারীদের জন্য যা করতে পারেনি, আপনি বাংলাদেশে তা করেছেন। আপনার মত নারী যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতেন তাহলে আমেরিকার নারীরা ধন্য হত। দুর্ভাগ্য নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

লেখক ঃএড. মো. মনতেজার রহমান মন্টু: 

সাবেক স্পেশাল পিপি
বগুড়া জজকোর্ট

আরো সংবাদ