খানজাহান আলী নিউজ ডেস্ক:: গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্য, স্থানীয় বৌদ্ধরা কর্তৃক বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়েছে অসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম নৃগোষ্ঠির নর-নারী। এদের আক্রমণে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে মা-বাবা হারা প্রায় দু’সহ¯্রাধিক অবুঝ শিশু। যাদের বাবা-মা বড়-ভাই বোনকে নির্মম শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে জীবন্ত কবর। আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
শুধু সেখানেই ক্ষান্ত হয়নি, ওই তথাকথিত নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নেতৃত্বে পরিচালিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা নির্যাতিত মুসলমানদেরকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে গায়ের মাংস পর্যন্ত কেটে নিতে দেখা গেছে। যুবক ও যুবতীদের হত্যা করে গাছের সংগে বেঁধে রাখা হয়েছে। মেয়েদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন এর মাত্রা আইয়ালে জাহিলিয়াতকেও ছাড়িয়ে গেছে। সেটা আমরা সামাজিক গণমাধ্যম থেকে জানতে পারছি। এসব বর্বরোচিত নির্যাতনের সর্বাধিক খারাপ অবস্থায় আছে ওই দেশে থেকে বিতাড়িত হওয়া প্রায় দু’সহ¯্রাধিক শিশু। যারা বাব-মা আশ্রয় সবকিছু হারিয়ে প্রবল অন্ধকার দেখছে। তাদের ভবিষ্যত কি হবে, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না?
এসব শিশুরা যে সব দৃশ্য দেখেছে তা তাদের বয়সে সহ্য করার মতো না। তারা মানসিকভাবে যে কষ্ট পেয়েছে তা তাদের মধ্যে এক প্রকার মানসিক ক্ষত তৈরি করেছে। তা সহজে সারবার নয়। হয়তোবা তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী পরিণত হবে। যদি তাদেরকে যথাযথ কাউন্সিলিং না করা হয়। এমনি কয়েকজন শিশুর জীবনের গল্প না বললে মনে হয় আমার লেখাটি সার্থকতা পায় না। আসুন আমরা ওই অসহায় শিশুদের সম্পর্কে কিছু জানায় চেষ্টা করি।
এক. রশিদ নামের একটি ১০ বছরের ছোট ছেলে কাঁধে একটি বোঝা নিয়ে ছোট বোন রশিদাকে নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বাবা জাহিদ হোসেন ও মা রমিজা খাতুনকে হত্যা করেছে। তারা আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে। তারা জানে না তাদের ভবিষ্যত কি হবে? রশিদ জানায়, পিতা ও মাতাসহ ছোট ভাই বোনকে নিয়ে তারা মংডুর শিকদারপাড়ায় থাকতো। হঠাৎ সেনাবাহিনী তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। এরপর রশিদ ও রশিদাকে নিয়ে জঙ্গলে লুকায়, সেনারা চলে গেলে বাড়িতে ফিরে দেখে সেনারা তাদের পিতা-মাতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আর দেরি না করে পিতা-মাতার লাশ রেখেই পালিয়ে তিনরাত হেঁটে তারা নাফ নদী পার হয়ে সেপ্টেম্বর মাসের এক তারিখে বাংলাদেশে আসে। সে বলেছে, সেনারা নাকি তার অন্য ভাই-বোনকেও গুলি করে হত্যা করেছে।
দুই. রাখাইনের মংডুর বার গোজিবিল গ্রামের দিলারা, (১১) এবং আজিজা (৯) ও তাদের পিতা মাতাকে হারিয়েছে। বড় বোন দিলারা বলে, দুপুরের খাবারের আগে তারা বাড়ির আঙ্গিনায় খেলছিল, এমন সময় সেনাবাহিনী তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে সে,তার ছোট বোন আজিজা এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ছোট বোন মুশতাকিমকে নিয়ে জঙ্গলে লুকায়। সেখান থেকে সে দেখতে পায়, সেনারা তার বাবাকে হত্যা করে ধারালো চাকু দিয়ে গলা কেটে এবং মা’র পেটে বড় ছুরি জোরে জোরে চালাচ্ছে। তারা ভয়ে আর দেরি না করে পালালো। পালানোর সময় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বোনকে সেনারা গুলি করল। জানিনা তার কপালে কি হয়েছে। সে কোথায় আছে তারা জানে না। এমন প্রেক্ষাপটে দিলারা ও তার আজিজা অন্য প্রতিবেশীকে সাথে নিয়ে ছুটলো অজানার আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। দিলারা বলল, সে সেখানে কোন স্কুলে পড়েনি, কারণ সেনারা সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রায় প্রায় হানা দিত।
তিন. নয়জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুইজন সদস্য বেঁচে আছে। তারা হলো নুর হোসেন (১২) এবং তার ছোট বোন জহুরা খাতুন (০৭)। তারা বাস করতো উত্তর রাখাইনের রডিয়ংসং গ্রামে। সেনাবাহিনী গত ২৫ আগস্ট তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে তাদের পিতা সুলতান আহমেদ এবং মাতা হাজেরা খাতুনকে হত্যা করে। পরে গ্রামের অন্যান্যদের সহযোগিতায় নাফ নদী পাড় হয়ে বাংলাদেশে আসে। নুর বলে, সে রাখাইনে অন্য শিশুদের সঙ্গে স্কুলে পড়তো। গত দুই বছর আগে রোহিঙ্গা শিশুদেরকে আলাদা করে অন্য স্কুলে দেওয়া হলো। তিনি আরও বলেন, তাদের বাবা-মা তাদেরকে অনেক ভালবাসত। আজ তাদের কথা অনেক মনে পড়ে। তারা আজ আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে। কখনও আর দেখা হবে না। আর কোন ভালবাসা তারা পাবে না।
চার. রাখাইনে বুচিয়াডং সাহেব বাজার এলাকায় আঞ্জুমান, তার ছোট ভাই ও বোনকে নিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় খেলছিল হঠাৎ সেনাবাহিনী এসে তাদের বাড়ীতে আক্রমণ করে। নির্বিচারে গুলি চালায়। তাদের বাবা গুরা মিয়া ও মা সামছুন্নাহারকে গুলি করে হত্যা করে। পরে সে তার বড় ভাই আনোয়ারের সাথে বাংলাদেশে আসে।
পাঁচ. জান্নাত আরা বেগম (১১) রাখাইন রাজ্যের কোনগিমাং গ্রামের বাসিন্দা। সে তার কাঠারে বাবা সৈয়দ আলম এর গলাকাটা লাশ দেখতে পেয়েছে। বাবা যখন বাজারে চাল আনতে গিয়েছিল এমন সময় মিয়ানমার সেনা সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। পরে গলা কেটে মাথাটাকে আলাদা করে দেয়। পরে মা আনোয়ারা তিন বোন ও চার ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মোট ৮ দিন-রাত হাটার পর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। বর্তমানে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় তারা অবস্থান করছে।
ছয়. রাশেদ নামক ছেলেটি আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরের সাথে করে নিয়ে এসেছিল, ছোট ভাইকে তার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। যখন সেনাবাহিনী তাদের বাবা-মাকে হত্যা করে গাড়ি দিয়ে তাদেরকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি অন্য সৈন্যরা তাদের বড় বোনকে শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছিল। মনে হয় তাকেও মেরে ফেলেছে। ওই মুহূর্তে রাশেদ মাঠে খেলতেছিল। অন্যের কাছে শুনে বাড়িতে এসে এ অবস্থা দেখে সে তার ছোট ভাই কামালকে নিয়ে ৯ দিন ৯ রাত অন্যের সাথে বাংলাদেশে পৌঁছায়। পরে একটি ছোট ঘরে অন্যদের সাথে রেখে খাবার সন্ধানে গেলে ফিরে এসে তার ছোট ভাইকেও পায়নি।
শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন অনেক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, এসব সর্বস্বান্ত শিশুরা ভয়ে ও আতঙ্কে তাদের মানসিকভাবে খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তাদের জন্য দীর্ঘদিনের কাউন্সিলিংএর প্রয়োজন। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তর ইতিমধ্যে বয়স বিবেচনা করে এসব শিশুদেরকে শ্রেণীভাগ করে তাদেরকে পূর্বের ন্যায় মানসিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে রাত-দিন। সমাজসেবা অধিদপ্তর এসব শিশুদের জন্য স্মাটকার্ড বরাদ্দ করেছেন এবং এসব শিশুদেরকে আলাদা করে রাখার জন্য জমি বরাদ্দের আবেদন করেছেন সরকারের কাছে। যাতে এসব শিশুরা কোন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হতে না পারে।
সর্বশেষ রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুরা নানা ধরনের রোগ-বালাইয়ে ভুগছে। পানি, খাবার স্যালাইন ও খাবারের তীব্র সংকট হচ্ছে। যদি সরকার ও বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবাসহ খাবার বিতরণ কর। ইতিমধ্যে সেই কাজকে সুচারুভাবে করার জন্য সেনাবাহিনীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে এবং গত কয়েকদিন থেকে সেনাবাহিনী সদস্যরা সেখানে ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যাবলি সঠিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছে তবে সেটা তো আসল সমাধান নয়।
আর একটা কথা ভাবার ব্যাপার যে, এসব এতিম এবং অসহায় শিশুরা কোথায় আশ্রয় নিবে? কিভাবে চলবে তাদের দিন? তারা কি খাবে? কোথায় ঘুমাবে? তাদের বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথার উপরে শুধু খোলা আকাশ, আর চারদিকে শুধু প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সর্বশেষ রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুরা নানা ধরনের রোগ-বালাইয়ে ভুগছে। পানি, খাবার স্যালাইন ও খাবারের তীব্র সংকট হচ্ছে। যদি সরকার ও বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবাসহ খাবার বিতরণ করা। ইতিমধ্যে সেই কাজকে সূচারুভাবে করার জন্য সেনাবাহিনীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে এবং গত কয়েকদিন থেকে সেনাবাহিনী সদস্যরা সেখানে ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যাবলি সঠিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছে তবে সেটা তো আসল সমাধান নয়।
আর একটা কথা ভাবার ব্যাপার যে, এসব এতিম এবং অসহায় শিশুরা কোথায় আশ্রয় নিবে? কিভাবে চলবে তাদের দিন? তারা কি খাবে? কোথায় ঘুমাবে? তাদের বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথার উপরে শুধু খোলা আকাশ, আর চারদিকে শুধু প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু রোহিঙ্গা শিশু নয়, রোহিঙ্গাদের সকল সমস্যা সমাধানে এবং তাদেরকে তাদের দেশে অতিসত্ত্বর ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ৫ দফা দাবি প্রস্তাব পেশ করেছেন জাতিসংঘের সাধারণ সভায়, আন্তর্জাতিক মহলের অবগতির জন্য। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানে আন্তর্জাতিক মহল সারা দেবেন এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করে বাংলাদেশকে মুক্ত করবেন।