আজ - মঙ্গলবার, ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ১:৩৯

যশোরে ১ ঘন্টা মোবাইল ভাড়া ৪০ টাকা! গেম খেলতে মিলছে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড!

যশোরে শিশু কিশোরেরা ভয়ানক রুপে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসুযোগ কোমলমতি শিশুদের পুঁজি করে একটি চক্র ব্যাপক বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে। তারা রীতিমতো দোকান খুলে বসেছেন। নামে-বেনামের দোকানে নিজস্ব কম্পিউটার ও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল দিয়ে বিভিন্ন গেমস খেলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এরপর ঘন্টা চুক্তিতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। শুধুই তাই নয় ঘন্টা চুক্তিতে তারা দিচ্ছেন আসক্ত শিশুদের ওয়াইফাই সুবিধা। যাদের মোবাইল আছে কিন্তু মেগাবাইট কেনার সুযোগ নেই তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াইফাই ভাড়া নিয়ে খেলায় মগ্ন থাকছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কোমলমতি শিশুদের কাছ থেকে টাকা হাতানোর ব্যবসা। শিশুরা একদিকে দোকান মালিককে টাকা দিচ্ছে অন্যদিকে গেমের ভেতরে বিভিন্ন ইভেন্টে টাকা খোয়া দিচ্ছে।  গত দুই দিনে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকেরা। তাদের ধারণা কখনো নিজেদের টাকা আবার কখনো বিভিন্ন ধরণের অপরাধে জড়িয়ে টাকা উপার্জন করে এ খেলায় মেতে উঠছে তারা। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে যশোর শহরের লোন অফিসপাড়া আদর্শ বিদ্যালয় মোড়ে গিয়ে দেখা যায় দুই সার্টারের একটি দোকান। একটি সার্টার বন্ধ, অপরটিতে পর্দা দেয়া। নেই কোনো সাইনবোর্ড। পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায় দুই কিশোর কম্পিউটারে ও আরো দুইজন মোবাইলে গেম খেলছে। একপাশে বসে আছেন দোকান পরিচালক। এসময় বহুবার কিশোরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কারো মুখে কথা শোনা যায়নি। তাদের ধ্যান জ্ঞান সব মোবাইল ও কম্পিউটারের মধ্যে। একপর্যায় তাদের মধ্যে সিয়াম ও আশরাফুল নামে দুই কিশোর জানায়, খালধার রোড বকুল তলার ইব্রাহিমের দোকান থেকে গেম খেলে শিশু কিশোরেরা বের হচ্ছে। তারা প্রতি ঘন্টা ৪০ টাকা করে ভাড়া নিয়ে খেলা করছে। কথা বলার সময় তাদের নেই। কথা হয় দোকানী তনুর সাথে। তিনি বলেন, শুধু তিনিই নন, যশোর শহরে এমন ব্যবসা অহরহ হচ্ছে। প্রতিমাসে তার ৮/১০ হাজার টাকা দোকান খরচ হয়। এরপর লাভ করে বাড়ি নিতে হয়। এছাড়া ব্যবসায় তিনি ৪টি কম্পিউটার ও চারটা অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন কিনেছেন।

এসময় আসে আরো তিন চারজন ১০/১২ বছরের কিশোর। তারা জানায়, খালধাররোড কদমতলা মোড়ের ইব্রাহিমের দোকান থেকে খেলে এবার এ দোকানে এসেছে গেম খেলতে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, টিমটি যায় কদমতলার সেই দোকানে। দেখা যায় সামনে বিকাশের সাইনবোর্ড ঝুলানো। ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায় তিনটি কম্পিউটার। তিন কিশোর খেলছে। এছাড়া আরো তিনজন বেঞ্চে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। কথা হয় কারাগারের এক রক্ষীর ছেলে লিমনের (১২) সাথে। সে জানায়, ঘন্টা প্রতি ৪০ টাকা ভাড়া করে কখনো কম্পিউটারে আবার কখনো মোবাইলে ফ্রি ফায়ার গেম খেলে। কিন্তু  সে প্রতিদিন আসায় তার কাছ থেকে ঘন্টা ৩০ টাকা করে নেয়া হয়। এসময় কথা হয় আশরাফুল নামে এক কিশোরের সাথে। সে জানায়, প্রথমে তার কাছে কাছে ফ্রি ফায়ার গেমস ভালো লাগত না। কিছুদিন বন্ধুদের দেখাদেখি খেলতে গিয়ে এখন সে আসক্ত হয়ে গেছে। এখন গেম না খেললে তার খুব অস্বস্তি লাগে। রারান্দিপাড়া থেকে আসা পলাশ (১৪) জানায়, সে পূর্বে গেমস সম্পর্কে কিছু জানতো না। এখন নিয়মিত ফ্রি ফায়ার গেমস খেলে। মায়ের কাছ থেকে টাকা না পেলে মাঝে মধ্যে ঘরবাড়ির উপর ভাংচুর চালায়। গেমস খেলতে না পারলে তার মাথা বিগড়ে যায়।
কয়েক কিশোরের তথ্য অনুযায়ী শহরের তজবীর মহলের সামনের একটি মিষ্টির দোকানের গলি দিয়ে গিয়ে বাম পাশে সিফাত কমিপউটারে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও একই অবস্থা। এক সার্টার বন্ধ রেখে চলছে ভেতরে কিশোরদের গেম খেলা। এখানে রয়েছে আরো উন্নত ব্যবস্থা। সিফাত কম্পিউটারের মালিক নিজেও খেলছেন। সাইবার ক্যাফের আদলে ছোট ছোট কামরা সাজিয়ে কিশোরদের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে।
এসময় খেলে বের হওয়া কয়েকজনের কাছে কেমন খরচ জানতে চাইলে তারা বলেন, খরচ সম্পূর্ণ নিজের কাছে। একটি অংশ দোকান মালিককে দিতে হয়। এছাড়া গেমের ভেতরে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলো না কিনলে নয়। যেমন অলকের দাম ৪০০ টাকা, একটা জার্সি ৩০০ টাকা, নতুন ইভেন্টে আসলেই ২০০০ টাকার নিচে খরচ না করলে হয় না তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শুরু করে উপজেলার পাড়া-মহল্লায় এ দৃশ্য নিত্যদিনের। পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সি শিক্ষার্থীদের আড্ডা ও অনলাইন গেম খেলার দৃশ্য চোখের পড়ার মতো।

সচেতন মহল বলছেন, শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল ও খেলাধূলার মাঠ ছেড়ে ইন্টারনেটে খেলছে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো নেশাধরা গেম। তারা এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে যা মাদকের চেয়ে ভয়ংকর। একসময় টাকার জোগান না পেলে কিশোররা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে উঠবে বলে অভিভাবকদের। কয়েকজন অভিভাবক জানান, বাধা দিলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। এসব কারণে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, শিশু কিশোরদের পুঁজি করে এধরণের ব্যবসা বাণিজ্য করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সাথে নিয়ে ওই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ্যাকশানে নামবেন বলে জানান।

আরো সংবাদ