আজ - মঙ্গলবার, ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সন্ধ্যা ৬:৪৮

যশোর-খুলনা মহাসড়কের কাজ শেষ না হতেই ফুলে ফেঁপে নষ্ট!

যশোর-খুলনা মহাসড়কের কাজ শেষ না হতেই ফুলে ফেঁপে নষ্ট হয়ে গেছে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ। গত নয়-দশ মাস পূর্বে সড়কটির যশোর-খুলনার সীমান্তবর্তী অংশ হতে যশোরের পদ্মবিলা অংশের প্রায় ১৯ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ কাজ শেষ করে দেশের খ্যাতনামা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং পদ্মবিলা থেকে শুরু করে যশোরের পালবাড়ী মোড় পর্যন্ত আরও ১৯ কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণ কাজ শেষ করে মাহাবুব এ্যান্ড ব্রাদার্স নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে চলতি বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই রাস্তার যশোর অভিমুখের বাম পার্শ্ব যানবাহন চলাচলের কারণে দেবে যায়। ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল সচল রাখতে বিভিন্ন অংশে মেশিন দ্বারা ফুলে ফেপে থাকা অংশগুলো কেটে পাথর ও বিটুমিন দিয়ে রিপেয়ারিং করতে দেখা যায়।

তবে চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই যশোর থেকে শুরু করে নওয়াপাড়ার শেষ সীমানা পর্যন্ত রাস্তার বেশিরভাগ অংশ আবারও ফুলে ফেপে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিয়ত মহাসড়কটি নষ্ট হয়ে যেন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে জনসাধারণের। যানবাহনগুলো ঝুকি নিয়ে নষ্ট হওয়া রাস্তার বিভিন্ন অংশ এড়িয়ে চলাচল করছে।

জানা গেছে, প্রায় ৩৪ কিলোমিটার এ সড়কটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। রাস্তাটি প্রায় ৩৪ ফুট চওড়া বাইন্ডার নির্মাণ করে রাস্তার দুই পার্শ্ব থেকে ৫ ফুট করে ১০ ফুট বাদ রেখে মাত্র ২৪ ফুট ওয়ারিং কোর্স করা হয়েছে। দুই লেনের এ মহাসড়কটি দিয়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৮০ টন মালামাল নিয়ে শতশত ট্রাক, লোভেট, বাসসহ ৬ থেকে ৭ হাজার যানবাহন চলাচল করে থাকে।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক দেশের স্বনামধারী প্রকৌশলী তুহিন বিন আজমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, রাস্তাটি সেকেলে ডিজাইনে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টন ক্যাপাসিটির যানবাহন চলাচলের উপযোগী সড়ক নির্মাণের যে টেন্ডার তারা পেয়েছিলেন মহাসড়কের সম্পূর্ণ সড়কের কাজটি তারা সেই ডিজাইনেই সম্পন্ন করেছেন।

তাহলে সড়কের এমন দূরাবস্থা হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ মহাসড়কে নওয়াপাড়া বন্দর ও খুলনা বন্দর থেকে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার যানবাহন চলাচল করলেও সওজের জরিপে সেটা ছিলো হাজার থেকে ১২ শত যানবহন চলাচলের জরিপ। তাছাড়া, অনেক পুরাতন ডিজাইনে রাস্তার বাইন্ডার ও ওয়ারিং কোর্সের কাজ করার কার্যাদেশ ছিলো। এছাড়াও তিনি বিটুমিনের গ্রেড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

তিনি জানান, “পাথরের সংগে বিটুমিনের গ্রেড যে পরিমাপে দেয়ার কথা আমরা সেটা সম্পূর্ণ রূপে সম্পন্ন করেছি। কিন্তু বিটুমিনের কাজ করার সময় সারাদেশের সাথে যশোর-খুলনার প্রাকৃতিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করতে থাকে। ওই অবস্থায় মহাসড়কের ডিজাইনের সাথে প্রকৃতির তাপমাত্রা খাপ খায়নি। ফলে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারনে রাস্তার বিভিন্ন অংশে যানবাহন চলাচলের কারনে পাথর ও বিটুমিন আলাদা হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বলেই আমাদের ধারনা।”

তিনি আরও বলেন, সওজ বিভাগের থেকে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিশেষজ্ঞ এনে সিডিউল ও ডিজাইন অনুযায়ী মহামড়ক নির্মাণ কাজ সঠিকভাবে হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার পর বিশেষজ্ঞদের অভিমতে বেরিয়ে এসেছে যে এ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি যে ডিজাইনে সম্পন্ন হওয়া উচিৎ, সেটি হয়নি।

তিনি বলেন, “কোম্পানীর সুনাম ধরে রাখার স্বার্থে আমরা যথাসাধ্য সতর্কতার সাথে সড়ক নির্মাণের কাজ করেছি। কিন্তু তাতে কোন ভালো ফল আসছেনা।”

মহাসড়কের এ বেহাল দশা কিভাবে হলো এবং তা যানবাহন চলাচলের উপযোগি ও দীর্ঘস্থায়ী কিভাবে হবে এ প্রশ্ন রেখে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দাবিকৃত ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের কথার সাথে অনেকাংশেই একমত পোষণ করে্ন।

তিনি জানান, খুলনা-যশোর মহাসড়কটি অত্যান্ত জনবহুল, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল এবং ট্রাক ও লোভেড গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করে চলাচল করার কারনে সড়কটি অতিদ্রুত বিভিন্ন অংশে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দুইটি তাদের ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করলেও বিটুমিনের কাজের সাথে প্রকৃতির তাপমাত্রার অনেকটা হেরফের হওয়ার কারণে এবং বিটুমিনের গ্রেড সঠিক না থাকায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, “আমরা বুয়েট, কুয়েটসহ আমাদের সওজ’র বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে রাস্তার বিভিন্ন অংশের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনেক ভুল-ত্রুটি পরীলক্ষিত হয়েছে। সড়কটি নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই বিভিন্ন অংশে ফুলে-ফেঁপে ও গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় সওজ’এর প্রধান কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবছে। সড়কের দু’পাশে পাঁচ ফুট করে দশ ফুট বাইন্ডার ছেড়ে মাত্র ২৪ ফুট ওয়ারিং কোর্স করার কারনে এবং খুলনা ও নওয়াপাড়া থেকে যশোর অভিমুখে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই যানবাহন চলাচলের ফলে সড়কটির একটি পার্শ্ব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।”

তিনি দৈনিক নওয়াপাড়াকে জানান, খুলনা-যশোর মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করেছে যাতে করে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করে যানবাহন চলাচল না করতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনে প্রতিটি গাড়ির ক্যাপাসিটি রাখতে তারা ওজন মাপযন্ত্র অর্থাৎ সরকারি স্কেল বসানোর চিন্তা ভাবনা করছে।

এছাড়াও সড়কটিকে স্থায়িত্ব দিতে ডিজাইনের পরিবর্তন এনে রাস্তার সম্পূর্ণ অংশটি ৬০ থেকে ৭০ মেট্টিক টন পন্য বোঝাই যানবাহন চলাচল উপযোগি করে ৩৪ ফুট সড়কটি সম্পূর্ণ অংশ বাইন্ডার দ্বারা নির্মাণ করার পরিকল্পনা সওজ নিচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে রাস্তাটির অতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জনসাধারণের অভিমতে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন মন্তব্য। নওয়াপাড়ার জনৈক ব্যবসায়ী অভিমত ব্যক্ত করেন শতশত কোটি টাকা ব্যয় করে নতুন সড়ক নির্মাণ করলেও পূণঃরায় সড়কটি পূর্বের মতো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের শতশত কোটি টাকা পানিতে ভেসে গেছে। আর জনসাধারণের যে দূর্ভোগ সেই দূর্ভোগই রয়ে গেছে। অথচ জন দূর্ভোগ দেখার কেউ নেই। তিনি আরও বলেন, সড়কটির দু’পাশের বড় বড় গাছ কেটে ফেলার কারনে মহাসড়কটি পূর্বের থেকে বর্তমানে আরও বেশি দূর্বল হয়ে গেছে।

আরো সংবাদ