অনুসন্ধানি প্রতিবেদন: নিরব ঘাতক ও স্বরব ঘাতক যখন তীব্র আকার ধারন করে স্থানীয় প্রশাসন তখন কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান। বারবার প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাদের।
ইতিমধ্যেই নিরব ঘাতক দমনে সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। বন্দুক যুদ্ধে মারাও গেছে অনেক কারবারি৷ গ্রেপ্তার হয়েছেন সহস্রাধিক। আইনের সিমাবদ্ধতার কারনে জামিনে বের হয়ে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে অনেক মাদক কারবারি।
প্রত্যেকটি জেলা শহরে একই রকম চিত্র দেখা গেলেও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হচ্ছে যশোর জেলাতে। জেলার সদর উপজেলায় মাদক কারবারির পরিমাণ কম নয় তাদের নিয়ন্ত্রণে সব সময় নিরবিচ্ছিন্ন নজরদারিও রেখেছেন জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এ প্রক্রিয়ায় আলোচিত কারবারিরা আটক হলেও বিচ্ছিন্ন কারবারির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিলো, আটকও হচ্ছিলো, জামিনে বেরিয়ে আবার শুরু করেছেন মাদক বিকিকিনি।
কিন্তু হটাৎ করেই মাদক কারবারিরা উধাও! কমে এসেছে মামলার পরিমাণও। এমনটা কেন?
সদর উপজেলার রামনগর ইউপি চেয়ারম্যান নাজনীন নাহার খানজাহান আলী ২৪/৭ কে জানান, আমাদের এখানে মাদক সেবি ও ব্যবসায়ীর প্রভাব একটা সময় প্রকট আকার ধারন করেছিলো, তারা আটক হয়েছে পুলিশের কাছে কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রনে আছে। এখন আর মকদকের প্রভাব চোখে পড়েনা৷ তারা কি কারাবন্দী আছে? এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান জানান, না। তারা জামিনে ছাড়া পেয়েছে কিন্তু মাদক ব্যবসায় আর জড়াচ্ছে না। কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কারবারিদের অনেকেই। আমরাও প্রশাসনের পাশাপাশি সজাগ দৃষ্টি রেখেছি। প্রশানের ভূমিকা উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন কোতয়ালী মডেল থানায় ওসি অপূর্ব হাসান আসার পর এই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিজ স্বামী প্রয়াত আলমগীর হোসেন হত্যা মামলার আসামি পাগলা শাহীন নিহতের ব্যপারে কোন মন্তব্য করতে চাননি চেয়ারম্যান নাজনীন নাহার।
চুরামনকাঠি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না জানান, মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নিতি থাকলেও ইতিপূর্বে তা সম্ভব হয়নি। ওসি অপূর্ব হাসান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় ৯০ শতাংশ কমে এসেছে কারবারিদের দৌরাত্ম্য। ১০ শতাংশ যারা আছে তারা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ লোক খেজুরের রস সংগ্রহ করে পান করে। সে ব্যাপারে প্রশাসন বা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমরা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। খেজুরের রস সমাজে কোন বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেনা সে কারনেই মূলত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। আগে যারা মাদক কারবারি ছিলো তারা কেউ ইজিবাইক চালাচ্ছে, কেউ দিনমজুর, কেউ দোকানপাট করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এর পরেও যদি কোন অভিযোগ আসে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা সহ পূনর্বাসন ব্যবস্থা পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে করে দিবো।
অনেকটা কারিশম্যাটিক ওসি পেয়েছি আমরা, যার কৌশল গত হস্তক্ষেপে মাদক শুধু নই সন্ত্রাসও কমে এসেছে শূণ্যের কোঠার কাছাকাছি।
দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান জানান, আমার ইউনিয়নে মাদক সন্ত্রাস শূণ্যের কোঠায়। কিছু বিচ্ছিন্ন মাদক সেবি রয়েছে যাদের ধরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, আস্তানা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওসি অপূর্ব হাসান সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন পরিচ্ছন্ন অফিসার। তিনি আমার এলাকায় এসে আমাদের সাথে নিয়ে সার্বিক খোজ খবর নিয়ে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তার ফলস্বরূপ আমার ইউনিয়ন এখন মাদক সন্ত্রাস মুক্ত। তিনি যশোরে আরো কিছুদিন থাকতে পারলে মাদকমুক্ত যশোর আপনাদের কে উপহার দিতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
বসুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম খান রাসেল জানান, আমার ইউনিয়ন মাদক সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য ছিলো। ওসি আজমল হুদা থাকতেও তিনি কোন অভিযোগ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। কিন্তু অপূর্ব হাসান আসার পর গভীর রাতেও তাকে পাই। তার কৌশলগত কারনে বসুন্দিয়া ইউনিয়নের মাদক সেবি ও ব্যবসায়ীরা এ সব কারবার ছেড়ে সাধারন জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছে। যারা আটক হয়ে জামিনে ছাড়া পাচ্ছে তারাও মাদকের রাস্তায় আর হাঁটছেননা – দোকানপাট, মাছের ব্যবসা, নসিমন, ইজিবাইক এসকল প্রক্রিযায় জীবিকা নির্বাহ করছে। তবে প্রশাসন ও আমার নজর রয়েছে তাদের উপর এবং আশপাশেও। কোন প্রকার বিরূপ আচরণ দেখলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এছাড়া যদি কারো কোন সহয়তা প্রয়োজন হয় আমি তাকে সার্বিক সহায়তা করবো। ওসি অপূর্ব হাসান মাঝে মাঝেই খোঁজ খবর রাখেন এবং সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপারেই আমার সাথে মতবিনিময় করেন। সে কারনে মামলার পরিমানও কমে এসেছে। কেউ চাইলেই কারো বিরূদ্ধে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলা দিতে পারছেনা৷ কারন অভিযোগ জমা দিলে আগে তদন্ত করে মিমাংশা যোগ্য কিনা সেটি খতিয়ে দেখে তারপর মামলা নথিভুক্ত করছেন। যার ফলে সমাজে হানাহানি হ্রাস পেয়েছে।
এ ব্যাপারে কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান খানাজাহান আলী ২৪/৭ কে বলেন। আইন দ্বারা সব কিছু সম্ভব নয়। আমার উদ্দেশ্য মাদক নির্মূল করা শুধু নিয়ন্ত্রনে সাফল্য আসতে পারেনা। সে কারনে যারা এ সমস্ত অবৈধ ব্যবসার সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ জড়িত তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে তাদের বোঝাতে হবে। মানুষের ধারনা পুলিশ মানেই থানায় নিয়ে মার, টাকা এসব। কিন্তু আমি সেটা করিনা। আটক হওয়ার পর থেকে কোর্টে যাওয়া পর্যন্ত তাকে আমি একজন ওসি হিসেবে বোঝায়, তাকে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেই,তার পরিবারের কথা, সন্তান সন্ততির কথা সব কিছু তার গহীন থেকে মনে করানোর চেষ্টা করি সব মিলিয়ে তাকে মোটিভেশন করি।
বুঝিয়ে বললে অনেক কিছু সম্ভব, আইনের সিমাবদ্ধতা থাকলেও মোটিভেশনের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। “আমাদের নবীজি (সাঃ) যে হাতে তরবারি ধরে যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের কচুকাটা করেছেন সে হাত দিয়েই গালে থাপ্পড় খাওয়ার পরও কাফেরের হাত মালিশ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি ব্যাথা পাওনি তো”। এই উত্তম আদর্শে আমাদের আদর্শিত হতে হবে। সমাজের প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে জন সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন অপূর্ব হাসান। সন্ত্রাসের ব্যাপারেও কঠোর অবস্থানে রয়েছেন ওসি। যদি সন্ত্রাসের কারনে ভিকটিম অভিযোগ করতে না পারে থানায় আসতে না পারে তাহলে পুলিশ সেখানে পৌঁছে যাবে। অচিরেই যশোর পুলিশের কে জনগণ বন্ধু বলে ডাকবে। সে প্রক্রিয়াই চলছে।
ফ্ল্যশব্যাক: বেনাপোল পোর্ট থানা উদ্বোধন করার পর এখানে প্রথম ওসি হিসেবে ২০০১ সালের ৫ এপ্রিল যোগ দেন মোঃ শাহাদৎ হোসেন। তিনি মাত্র ৩ মাস থাকার পর বদলি হন ১৯ জুলাই। পরবর্তী ওসি হিসেবে যোগ দেন ১৯ জুলাই সৈয়দ মোস্তফা কামাল (পিপিএম)। মাত্র ১৮ দিনের মাথায় তাকে চলে যেতে হয়। এর পর যোগ দেন একই সালের ১৩ আগস্ট কে,এম সাইফুল হুদা। তিনি ৪ মাসের মাথায় ১০ ডিসেম্বর বেনাপোল ছাড়েন। ৪র্থ ওসি হিসেবে যোগ দেন ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর ফারুক আহমেদ খসরু (বিপিএম)। তৎকালিন বিএনপি দলীয় এমপি আলী কদরকে এমপি হিসেবে প্রটেকশন দেওয়ায় বিএনপির হাওয়া ভবনের এক নেতার কুনজরে পড়ে এখান খেকে বদলী হতে হয় তাকে ৪ মাসের মাথায় ২০০২ সালের ১৩ এপ্রিল। ৫ম ওসি হিসেবে যোগ দেন ২০০২ সালের ২৪ মে শফিকুল আলম। তিনি হাওয়া ভবনের এক নেতার আর্শিবাদে এখানে স¤্রাজ্য বিস্তার করেন ২ বছর। অবশেষে ২০০৪ সালের ২ মার্চ তিনি বদলি হন। ৬ষ্ঠ ওসি হিসেবে ২০০৪ সালের ১৮ মার্চ যোগ দেন জালাল উদ্দিন। তিনি ২০০৫ সালের ১২ এপ্রিল বদলী হন। ৭ম ওসি হিসেবে যোগ দেন একই সালের ১২ এপ্রিল আগের থাকা ওসি সৈয়দ মোস্তফা কামাল (পিপিএম)। এবার আর তাকে ১৮ দিনের মাথায় চলে যেতে হয়নি। তিনি প্রায় দেড় বছর এখানে থাকার পর ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর বদলী হন। একই তারিখে ৮ম ওসি হিসেবে যোগ দেন মুকবুল হোসেন মোল্যা। তাকে বিদায় নিতে হয় দেড় মাসের মাথায় ২৬ নভেস্বর। ২৭ নভেম্বর ৯ম ওসি হিসেবে যোগ দেন শাহাদৎ হোসেন খান। ৬ মাসের মাথায় তাকে বদলী করা হয় ১ জুন ২০০৭ সালে। ১০ম ওসি হিসেবে নিয়োগ পান ১ জুন আবুল বাশার। তাকেও ৭মাসের মাথায় বদলী করা হয় ৩১ জানুয়ারি ২০০৮ সালে। ১১তম ওসি হিসেবে নিয়োগ পান ১ ফেব্রুয়ারী নুরুল আমিন। এক বছর ৩ মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ১০ মে চলে যান অন্যত্র। একই তারিখে ১২তম ওসি হিসেবে যোগ দেন এনামুল হক। নানা দুর্নীতির কারণে তাকে বদলী করা হয় ২০১০ সালের ২ মার্চ। ২২ মার্চ ১৩তম ওসি হিসেবে যোগ দেন আসলাম খান। বেনাপোলে বৈশাখী মেলায় বোমা হামলাসহ অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নেওয়ায় তাকে সাসপেন্ড করা হয়। বোমা হামলায় জিয়াউর রহমান জিয়া নামে এক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত ও ১০ জন আহত হয়। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তাকে ৬ মে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। ১৪তম ওসি হিসেবে ১৬ মে যোগ দেন ওসি আবু বকর সিদ্দিকী। অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে ওসি শেখ আবু বক্কর সিদ্দিকীকে সাড়ে ৬ মাসের মাধায় ৬ ডিসেম্বর বদলী করা হয়। এর ২দিন আগে মদ খেয়ে মাতলামী করার অভিযোগে ক্লোজড করা হয় থানার সেকেন্ড অফিসার আজমল হুদাকে। ১৫তম ওসি হিসেবে একই দিন যোগ দেন শামিম মুছা। ৯ মাসের মাথায় ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে বদলি করা হয়। ১৬তম ওসি হিসেবে ১৬ সেপ্টেম্বর শার্শা থানা থেকে আসেন হাসান হাফিজুর রহমান । হুন্ডির ৩৫ লাখ টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর তাকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়। এর আগে একই অভিযোগে দুই উপ-পরিদর্শক ও এক কনস্টেবলকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়। ১৭তম ওসি হিসেবে ৬ ডিসেম্বর যোগ দেন এ কে এম ফারুক হোসেন। আড়াই মাসের মাথায় তাকে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ হঠাৎ করে বদলি করা হয়। একই তারিখে ১৮তম ওসি হিসেবে আসেন মিজানুর রহমান খান। আইন শৃংখলার অবনতি ও ক্ষমতাসীন দলের দু’গ্রুপের রোষানলে পড়ে সাড়ে ৬ মাসের মাথায় ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে বদলি করা হয়।
১৯তম ওসি হিসেবে ওসি কাইয়ুম ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বেনাপোল আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন ওসি হিসেবে যোগ দিয়ে ৬ দিনের মাথায় বেনাপোল পোর্ট থানায় যোগ দেন। ২০তম ওসি হিসেবে ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী যোগ দেন মোশাররফ হোসেন। তাকে বদলি করা হয় মাত্র ২ মাসের মাথায়।
সর্বশেষ ২১তম ওসি হিসেবে যোগ দেন একই তারিখে বর্তমান ওসি অপূর্ব হাসান। তিনি ঢাকার তেজগাঁও থেকে বদলী হয়ে যোগ দেন চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনে। সেখান থেকে পোর্ট থানায় যোগদান করেন ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল। তিনিই এক মাত্র ওসি হিসেবে এ থানায় দীর্ঘ বছর দায়িত্ব পালন করছেন এবং সিমান্তে পুলিশ বিজিবির যৌথ টহলের প্রস্তাবক ছিলেন তিনি। সিমান্তে যৌথ অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে।
গত ১০ জুলাই ওসি অপূর্ব হাসান কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিগত সময়ে মামলার সংখ্যা ছিল ১৫০ টি কিন্তু তিনি যোগদানের পর সর্বমোট মামলার সংখ্যা ৭৩ টি।
প্রতিবেদন টি তৈরি করেছেন আমাদের জোষ্ঠ্য প্রতিবেদক : মামুন মুনতাসির।