আজ - শনিবার, ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ২:৪০

স্কুটার চালক থেকে সফল শ্যামলী পরিবহনের মালিক!

সিফাতুর রহমান: দারিদ্র্যকে জয় করে যারা স্বপ্ন পূরণ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘শ্যামলী পরিবহনের’ চেয়ারম্যান গনেশ চন্দ্র ঘোষ। চুয়ালি্লশ বছর আগে একটি জীর্ণ পুরাতন স্কুটার থেকে একটি চকচকে নতুন বাস কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পাবনা শহরের শালগাড়িয়ার অভাবী ঘরের সেই গনেশ চন্দ্র ঘোষ আজ গোটা দেশের পরিবহন খাতের এক দিকপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার সেই জীর্ণ স্কুটারটি যেন এক চারাগাছ, যা এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

তখন কেবল স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। গনেশ ঘোষদের পরিবারেও ছিল শতেক রকমের অভাব-অনটন। তবু স্বপ্নবান মানুষটি এই অভাব-অনটনের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। পড়াশোনা করার সময়ই তিন চাকার একটি স্কুটার কিনেফেলেন তিনি।

জমানো কিছু টাকা তো ছিলই। সঙ্গে ধার-কর্জও করতে হয়েছে। পাবনা শহর থেকে সুজানগর উপজেলা পর্যন্ত স্কুটারে যাত্রী বহন করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চলত। গণেশ চন্দ্র ঘোষ নিজেও স্কুটার চালাতেন। বড় সন্তান হিসেবে সংসারের ঘানি টানতে টানতেই একদিন তিনি পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে রসায়নে সম্মান ডিগ্রিটাও অর্জন করে ফেললেন। মেজ ভাই রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও ছোট ভাই রমেন্দ্রনাথ ঘোষ নিয়মিত স্কুটার চালাতেন। আজকের শ্যামলীর বিশাল সাফল্যে এই দুই ভাইয়ের শ্রমও স্মরণীয়। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় ভাই গণেশ চন্দ্রের পাশে থেকে কঠোর পরিশ্রম করেছেন রমেশ ও রমেন্দ্র।

ওই সময় পাবনা শহর থেকে সুজানগর আর পাকশী ফেরিঘাট পর্যন্ত চালানো হতো স্কুটারটি। পাবনা-সুজানগর ১২ কিলোমিটার পথের যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছিল পাঁচ টাকা। পাকশী ফেরিঘাট পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার চালিয়ে প্রতিজনে পেতেন ৭-৮ টাকা। প্রতি ট্রিপে চারজন যাত্রী বহন করে যা পাওয়া যেত সে দিয়ে সংসারের খরচ বহনের পর কিছু জমানো হতো। এভাবেই কিছুদিনের মধ্যে আরও কয়েকটি স্কুটারের মালিক হয়ে গেলেন তারা।

সেই পুরনো স্কুটারটিতেই গোড়াপত্তন হয়েছিল আজকের শ্যামলী পরিবহনের। এই নামটি প্রথম লেখা হয় জীর্ণ-শীর্ণ সেই স্কুটারটির গায়ে। এখন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের গৌরব বহন করছে সেই নাম। ধর্মীয় চিন্তা থেকেই স্কুটারটির নাম রাখা হয়েছিল শ্যামলী পরিবহন। দেবতা শ্রীকৃষ্ণের শ্যামলী, ধবলী, কাজলী নামের ধেনুর (গাভী) মধ্য থেকেই ‘শ্যামলী’ নামটি রাখা হয়েছিল। মা-বাবাসহ সাত ভাই, চার বোনের ১৩ সদস্যের পরিবারের সদস্যরা বসে আলোচনা করেই ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ থেকে নামটি রেখেছিলেন।

গণেশ চন্দ্রের এই উদ্যোগে প্রেরণা জুগিয়েছেন তার বাবা মৃত অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ। এতকাল পর পুরনো সেই সব দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বাবার স্মৃতিচারণ করেন। ঢাকায় শ্যামলী পরিবহনের প্রধান কার্যালয় বিলুপ্ত শ্যামলী সিনেমা হলের খুব কাছাকাছি একটি ভবনে। সেখানে ছোট্ট একটি টেবিল, একটি কাঠের চেয়ার। এখানে বসেই প্রতিদিন অফিস করেন চেয়ারম্যান গণেশ চন্দ্র ঘোষ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখোমুখি বসেন তিনি।

অতি সাধারণ পোশাকে নম্রতা ও ভদ্রতার এক এক মূর্ত প্রতীক যেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিরা আধুনিক অফিসে বসেন, বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন, আপনি তাদের থেকে ভিন্ন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘শান-শওকত আর বিলাসী জীবন-যাপন করলে যাত্রী সেবার মানসিকতা থাকে না। এই সাধারণ জীবন-যাপনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমি।’ জীবনের এক পর্যায়ে তিনি পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের রসায়ন বিভাগে প্রদর্শক শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অবসরে যান ২০০৯ সালে।

সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত মানুষটি এখন শ্যামলী পরিবহন নামে এক সাম্রাজ্যের অধিকর্তা। জীবনের চড়াই-উৎরাই পার করে আজ তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন খাতের সার্থক এক ব্যবসায়ী। তার শ্রম, মেধা ও কঠোর পরিশ্রম নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।

শুরুতে স্বপ্নটা এত বড় ছিল না। নতুন একটি বাসের মালিক হবেন_ এই স্বপ্নটুকুই পুঁজি ছিল গণেশ চন্দ্রের। তিনি বললেন, স্বাধীনতার পর প্রথম যে স্কুটারটি তিনি কিনেছিলেন সেটি কেনা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। দাম কত পড়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে যতদূর মনে করতে পারেন ৭-৮ হাজার টাকায় কেনা হয়েছিল পুরনো ওই স্কুটারটি। পরে আরও কিছু টাকা খরচ হয়েছিল স্কুটারটি সংস্কার করতে। এক সময় পুরনোটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি স্কুটার।

পরে স্কুটারগুলো বিক্রি করে যে টাকা হয়েছিল তা দিয়ে একটি পুরনো বাস কেনা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তখনও নতুন বাস কেনার স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যায়। রাজশাহী থেকে নগরবাড়ি পর্যন্ত চালানো হতো পুরনো ওই বাসটি। বাস চালিয়ে উপার্জিত অর্থ, পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির অর্থ এবং সোনালী ব্যাংক পাবনা জেলা শাখা থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ১৯৭৮ সালে কেনা হয় চকচকে একটি নতুন বাস। সেদিনই পূরণ হয় গণেশ চন্দ্রের নতুন বাস কেনার স্বপ্ন। তখন থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর বছরে বছরে কেনা হয় নতুন নতুন বিলাসবহুল আধুনিক বাস।

১৯৭২ থেকে ৪৪ বছর পর আজ পরিবহন সেক্টরে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গণেশ চন্দ্র ঘোষ। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও চলে তিল তিল করে গড়ে তোলা শ্যামলী পরিবহনের বাস। দেশে-বিদেশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার টিকিট কাউন্টার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে এই পরিবহনে। বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিধি ক্রমে বেড়েই চলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার সর্বত্র চলে শ্যামলী পরিবহনের বাস। অর্থাৎ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া শ্যামলীর সেবা আছে সর্বত্রই।

আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে ঢাকা-কলকাতা, আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি-ঢাকা, ঢাকা-বুড়িমারি-শিলিগুড়ি, চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতায় (ট্রানজিট) চলছে শ্যামলীর বাস। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রুটে চালানো হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১০টি অত্যাধুনিক বাস। দেশের অভ্যন্তরে শ্যামলী ব্র্যান্ডের বাসের সংখ্যা ৪শ’ ৫০টি। এর মধ্যে অর্ধশত বাস শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

এখন দেশে-বিদেশে শ্যামলী পরিবহন একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তাদের আধুনিক একটি চেয়ার কোচের দাম ৭০ লাখ টাকা। অত্যাধুনিক বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বাসের দাম দেড় কোটি থেকে পৌনে দুই কোটি টাকা। একদিন যারা জীবনের তাগিদে ৭-৮ হাজার টাকায় পুরনো স্কুটার কিনে চালাতেন আজ তারাই পৌনে ২ কোটি টাকায় আন্তর্জাতিক মানের বাস কেনেন। দেশ-বিদেশে যারা দারিদ্র্যের রাহু থেকে মুক্ত হয়ে জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়েছেন, তারাই আজ ওইসব দেশে ইতিহাসের অংশ। শ্যামলীও আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ।

চুয়ালি্লশ বছর আগের ৭-৮ হাজার টাকার বিনিয়োগ আজ ৪০০ কোটির ঊর্ধ্বে পৌছেছে। পাবনা-ঢাকা প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় ১৯৭৯ সালে। কুষ্টিয়া-ঢাকা প্রথম নাইট কোচ চালু করা হয় ১৯৮১ সালে। আন্তর্জাতিক রুটে বাস চলাচল শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। আন্তর্জাতিক রুটে বাস চালানোর জন্য ওই সময় সরকারি উদ্যোগে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল খ্যাতনামা ১২টি বাস কোম্পানি। তার মধ্যে গুণগতমানসহ সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে নির্বাচিত হয় শ্যামলীর বাস। ওই সময়ই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বাস চালানোর জন্য সরকারের সঙ্গে শ্যামলী কর্তৃপক্ষের এক চুক্তিও হয়েছিল।

বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশে শ্যামলী পরিবহনের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। এই সাম্রাজ্যে প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে। দেশের ভেতরে টিকিট কাউন্টারের সংখ্যা তিনশ’র বেশি। প্রতিষ্ঠানের জিএম, অঞ্চলভিত্তিক ম্যানেজার, কাউন্টার মাস্টার, টিকিট বিক্রেতা, চালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হিসাব বিভাগ, মেইনটেন্যান্স, প্রধান মেকানিক, সহকারী, সার্ভিসিং সেন্টার, ক্লিনিং, চেকআপ, বডি মেরামত গ্যারেজ, পার্কিং অ্যান্ড ফুয়েলিং স্টেশনসহ নানা ইউনিট রয়েছে।

পরিবহন খাতের ঝুঁকি সম্পর্কে গণেশ চন্দ্রের মেজ ভাই শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেছেন, ফুটবল খেলে মারধর করা হলেও একপর্যায়ে গাড়ি ভাংচুর শুরু হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও রাস্তায় চলা গাড়িগুলো হয়ে ওঠে প্রধান শত্রু। শুরু হয় ভাংচুর। সবচেয়ে ভয়ানক হলো পুড়িয়ে দেওয়া। একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলে সেটি সচল করার মতো কোনো অবস্থা থাকে না। মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে যায় দামি একটি বাস। এরপর দুর্ঘটনাতো আছেই।

শ্যামলী পরিবহনের কোনো বাস দুর্ঘটনার শিকার হলে দুর্ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী অফিসের দায়িত্বশীল লোক দ্রুত সেখানে চলে গিয়ে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন। শ্যামলী পরিবহন কর্তৃপক্ষই এই চিকিৎসার খরচ বহন করে। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে সাধ্যমতো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে সহমর্মিতাও জানানো হয়।

শ্যামলী পরিবহনের চেয়ারম্যান গণেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘যাত্রী সেবাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। একটি গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীদের যতটুকু সেবা দেওয়া দরকার আমরা ততটুকু দিই। যাত্রীরাই আমাদের অমূল্য সম্পদ। সেবা দিয়ে আমরা তৃপ্তি পাই।’ তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল বলেই দেশের পরিবহন খাতের উন্নয়নের আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’

আরো সংবাদ