আজ - শুক্রবার, ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ৯:২৭

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর ও রক্তক্ষয়ী : এসএম কামাল হোসেন।

রক্তস্নাত ২১ আগস্ট। দেড় দশক আগে এই দিনে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় হরকাতুল জিহাদের একদল জঙ্গি, যা ছিল ছয় বছর ধরে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক চেষ্টার এক চূড়ান্ত রূপ।

একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি যোগাযোগ এবং সরকারের উদাসীনতা ও ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতা বা পৃষ্ঠপোষকতায় একটি উগ্রপন্থী গোপন সংগঠন কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, সেটারও একটা বড় উদাহরণ হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি)।

১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০–র বেশি মানুষ। আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সমাবেশ, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর এসব হামলা হয়। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকেই হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে অন্তত চার দফা।

কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও এরপর বিএনপি সরকার এই জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক অজানা তথ্য।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজি–বির প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি গ্রেপ্তার হন। শীর্ষ জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘদিন এই জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো তৎ​পরতা দৃশ্যমান নেই। তবে দেশে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি শেষ হয়ে যায়নি। আইএস ও আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের মতাদর্শ অনুসরণকারী একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন মাত্রার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে সেটার ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে। সম্প্রতি ঢাকায় কয়েকটি পুলিশ বক্সের কাছে বোমা পেতে রেখে এবং পুলিশের একটি গাড়িতে সময়নিয়ন্ত্রিত বোমা ফাটিয়ে আইএস মতাদর্শী জঙ্গিরা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। দেশে এখন আলোচনায় রয়েছে প্রধানত তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠী—জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আইএসপন্থী নব্য জেএমবি ও আল-কায়েদাপন্থী আনসার আল ইসলাম। হোলি আর্টিজানের হামলা বাদ দিলে এই তিনটি গোষ্ঠীর কেউই হুজি-বির মতো এত বেশিসংখ্যক বড় হামলা চালাতে পারেনি।

আফগানফেরত মুজাহিদদের গড়া সংগঠন হুজি-বি এ দেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন করেছিল। বাংলাদেশ থেকে যেসব ব্যক্তি তৎকালীন সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা ছিলেন কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষিত। সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করার পর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল হুজি-বির বিস্তারপর্ব। শুরুতে তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতের কাশ্মীরে এবং মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের হয়ে লড়াই করা। কাশ্মীরের ও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তও ছিল হুজি-বি।

১৯৯৮ সালের পর থেকে হুজি-বি রোহিঙ্গাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে এ দেশের ভেতরে নাশকতামূলক তৎপরতা শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) শেষ তিন বছর হুজি-বির জঙ্গিরা আটটি বড় ধরনের বোমা হামলা চালিয়েছিল। তখন তিন দফা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় এই জঙ্গিরা। এর মধ্যে প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালের জুলাইয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দূরনিয়ন্ত্রিত দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখে। কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি। কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকাভর্তি ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়া সবাই কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে যান।

এরপর ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় হত্যার পরিকল্পনা করেন হুজির জঙ্গিরা। কিন্তু শেখ হাসিনা সিলেট পৌঁছান নির্ধারিত সময়ের অনেক পর। জনসভা ছিল সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে। তিনি সভাস্থলে পৌঁছার পর রাত আটটার দিকে কাছাকাছি এলাকায় একটি মেস ঘরে জঙ্গিদের তৈরি বোমা কোনো কারণে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। শেখ হাসিনা তখন সভামঞ্চে ছিলেন। এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে দুই জঙ্গি নিহত হন। আহত অবস্থায় হুজি-বির দুই সদস্য মাসুদ আহমেদ (শাকিল) ও আবু ওবায়দা গ্রেপ্তার হন। তখন আসামি মাসুদ আহমেদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বিবরণ দিলেও কিছুদিন পর পুরো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর ও ১৯ নভেম্বর হুজির দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা আবু সাইদ ও মুফতি হান্নানের দেওয়া জবানবন্দিতে এই হত্যাচেষ্টার কথা বলেন। পরে এই ঘটনার নতুন করে তদন্ত শুরু হয়।আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে শেখ হাসিনাকে চার দফা হত্যার চেষ্টা করে হুজি-বি। সর্বশেষ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর ও রক্তক্ষয়ী।

হুজি–বির কার্যক্রম এখন অনেকটাই স্তিমিত। তবে হুজি–বির সদস্য বর্তমানে কী অবস্থায় আছে; তারা অন্য কোনো সংগঠনে যোগদান বা নতুন কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ গড়ে তুলেছে কি না বা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে কি না; সে বিষয়ে সরকার তৎপর রয়েছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে এ দেশে জঙ্গিবাদের হুমকি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। জঙ্গি বা সহিংস উগ্রবাদের ঝুঁকিকে কোনো অংশেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

আরো সংবাদ