বিশেষ প্রতিনিধিঃ এক দিকে করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতি। অন্যদিকে মাছের সীজন শুরু হয়েছে। বড় দু:শ্চিন্তার মধ্যেই ব্যস্ততায় যশোরের নার্সারি ও হ্যাচারি মালিকরা। দিন রাত তারা হ্যাচারীতে রেনু পোনা উৎপাদনে ব্যস্ত। পুকুর তৈরির কাজ চলছে একই সাথে পুরোদমে। যশোরের সর্বত্র এখন মাছের রেনু ও পোনা চাষের জন্য পুকুর তৈরি করছে মাছ চাষীরা। ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে শহরের সব্জীবাগ, চাঁচড়া, বর্মণ পাড়া, বলাডাঙ্গা, রামনগর ও কাজিপুরে। শার্শায় হ্যাচারিতেও একই ব্যস্ততা। করোনার মধ্যেও ক্রেতারা আসতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন সীজন শুরু হয়েছে।
রেনু ও পোনার ব্যাপক চাহিদা এই মুহুর্তে। চাচড়া, বর্মনপাড়া, গোলদার পাড়া রামনগর ও বলাডাঙ্গা কাজীপুরে দিনরাত পরিশ্রম করছে হ্যাচারী মালিক ও তাদের প্রতিনিধিরা। কোন কোন হ্যাচারীতে ইতিমধ্যে কয়েক চালান রেনু উৎপাদন করে মাছ চাষীদের কাছে সরবরাহ করেছে। আর কয়েক দিনেই পুরোদমে হ্যাচারী গুলোতে রেনু ও ডিম উৎপাদন ও সরবরাহ শুরু হবে। এখন চলছে ব্রুড বা মা মাছের পরিচর্যা ও ডিমের পরাগায়ন পর্ব। কোন হ্যাচারী মালিক ডিম উৎপাদনের সকল প্রস্তুতি শেষ করেছেন। হ্যাচারীর সাথে সাথে পুকুর তৈরি ও রনা বেনের কাজ চলছে দিন রাত। প্রথম দিকে রেনুর মূল্য বেশি থাকে এ কারনে ফার্স্ট বাজার ধরতেই হ্যাচারী মালিকদের এই তীব্র পরিশ্রম। পাশাপাশি চলছে বাবলা তলায় পোনা বিক্রির হাপা তৈরির কাজ।
খুলনা বিভাগে মাছ উৎপাদনে প্রথম স্থানে রয়েছে যশোর। বছরে জেলা থেকে মাছ উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৮ টন। আর পিছিয়ে রয়েছে মেহেরপুর জেলা। সেখানে মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে ৮ হাজার ৮৭৫ টন। বিভাগের ১০ জেলায় বছরে মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৪০৫ টন। এর মধ্যে চিংড়ি মাছ রয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ২১৮ টন।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের এক কোটি ২৫ লাখ লোক মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। শুধুমাত্র যশোর জেলায় ৩২ লাধিক মানুষ সরাসরি মাছ চাষে নিয়োজিত। এ জেলায় ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুর রয়েছে। বাঁওড় রয়েছে ১৩ হাজার ৩৯১ হেক্টর। যশোর সদর উপজেলায় সাদা মাছ ও পাঙ্গাশ রেণু উৎপাদন করছে প্রায় ৫০ টি হ্যাচারি। আর পুরো জেলা জুড়ে এমন হ্যাচারির সংখ্যা ৭০ টির বেশি। এসব খামারে রেণু উৎপাদন হয় ৬০,০০০ কেজির বেশি। যা থেকে পোনা উৎপাদন হয় প্রায় ৫০ কোটি। তবে এর বাইরেও কিছু হ্যাচারী রেনু উৎপাদন করছে। যেমন চাচড়া রুদ্রপুর শ্যামলছায়া পার্কে রয়েছে একটি বড় ফিশ হ্যাচারী। মাছ চাষ ও রেনুপোনা উৎপাদনে রেকর্ড রয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের। চাহিদার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে যশোরে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত এ মাছ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮লাখ ৩২হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৯ মেট্রিকটন রেনুপোনা ও ২ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ মেট্রিকটন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেনুপোনা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৭ মেট্রিকটন। এছাড়া মাছ উৎপাদিত হয় ১লাখ ৭৯ হাজার ৯৯৮ মেট্রিকটন। যশোর জেলার ক্রমবর্ধমান এ সাফল্য জাতীয় অর্থনীতিসহ পুষ্টি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
সারা দেশে মাছ উৎপাদনে যশোর জেলার অবস্থান দ্বিতীয়। জেলার জলায়তন রয়েছে ৭৫লাখ ৪৮হাজার ৪৪০ হেক্টর। এরমধ্যে বদ্ধ পুকুর ও বাওড়ের জলায়তন ৪১ হাজার ৪০০ হেক্টর ও উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ১৯ হাজার ৫০৭ হেক্টর। এই জলায়তনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যশোরে কার্প জাতের (সাদা) মাছের উৎপাদন হয়েছে ২লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে ১লাখ ৬৪ হাজার ২২৩ মেট্রিক টন।
এদিকে সাদাসোনা চিংড়ি ও বাগদার উৎপাদিত হয়েছে ৬,৭৫১ মেট্রিক টন। এই চিংড়ি মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে যশোরে স্থাপন করা হচ্ছে মাছের পোনার আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্র। এছাড়া রেনুপোনা এবং মাছ উৎপাদনে যশোরে নয়টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। অভয়াশ্রমগুলো হলো- যশোর সদরের বুকভরা বাওড়, মণিরামপুরের খাটুরা ও খেদাপাড়া, অভয়নগরের পোড়াখালী, ঝিকরগাছার উজ্জ্বলপুর, কেশবপুরের মর্শিনা বাওড়, শার্শায় কন্যাদহ, বাঘারপাড়ার চিত্রা নদী ও চৌগাছার বেড়গোবিন্দপুর বাওড়। এসব অভয়াশ্রমে বছরে ৩০ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়।
যশোরের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মৎস্যজীবী সাইফুজ্জামান মজু বলেন, সত্তর থেকে আশির দশকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যশোরে কার্পজাতীয় রেনুপোনা উৎপাদন শুরু হয়। ব্যবসায়ী ও চাষিদের অকান্ত পরিশ্রমে জেলার চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে দেশের রেনুপোনার শতকরা সত্তর ভাগই যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। এখানে কার্প, তেলাপিয়া ও গলদা হ্যাচারি রয়েছে প্রায় ৫০টি নার্সারি রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। যেখানে উৎপাদিত হয় কয়েক কোটি পোনা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, রুই মাছের জাত উন্নয়ন, বাওড়ের রুই জাতীয় মাছের ব্রান্ডিংকরণ, রুই জাতীয় মাছের গুণগতমানের রেনু উৎপাদন নিশ্চিত করা, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর জন্য মৎস্য হ্যাচারিতে পানির রিসাইকিন পদ্ধতি সম্প্রসারণ, নিরাপদ মৎস্য খাদ্য ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং রোগ সনাক্তকরণ এবং বিষাক্ততা পরীণে ল্যাব স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যশোরের মাছ চাষিরা দেশের সার্বিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
চাঁচড়া মৎস্য পল্লী এলাকা ছাড়াও যশোর সদর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে অসংখ্য হ্যাচারি। পাশাপাশি পোনা উৎপাদনের জন্য গড়ে ওঠে নার্সারি খামার। অনেকেই প্রতিষ্ঠা করেন রেণুপোনা উৎপাদন খামার। ইতিমধ্যে কয়েক চালান পাবদা রেনু পোনা সরবরাহ করেছেন। যশোর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মাতৃ ফিশ হ্যাচারী মালিক জাহিদুর রহমান গোলদার জানান, এই জেলায় উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মাছ দেশের অন্যান্য এলাকার চাহিদা পূরণ করছে। এখানে রেণুপোনা উৎপাদনে এই এলাকার অর্থনীতির গ্রাফ উর্দ্ধমূখী। তা দেশের সামগ্রীক মাছ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। ইতিমধ্যে তার হ্যাচারিতে ডিম বা রেনু উৎপাদন ও সরবরাহ শুরু হয়েছে।
এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় ফাল্গুনের শেষ দিকেই অনেক হ্যাচারী উৎপাদনে যেতে পেরেছে। যশোর থেকে সারাদেশে রেণু ও পোনা সরবরাহ করলেও বর্তমানে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোর জেলায় সরবরাহ করছেন। যশোরে যত জাতের রেণু উৎপাদিত হয় দেশের অন্য কোনো হ্যাচারিতে এত জাতের রেণু উৎপাদন হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে যশোরের মাটি ও পানি রেণু উৎপাদনের জন্য দেশের মধ্যে সেরা। যশোরে উৎপাদিত রেণুর মধ্যে রয়েছে কমন কার্প, গ্রাস কার্প, বিগ হেড, সিলভার কার্প, মৃগেল, রুই, থাই সরপুঁটি, কাতলা, পাঙ্গাশ, বাটা, কালবাউস, ব্লাককার্প, পাবদা, দেশি মাগুর, সিং, ট্যাংরা বা গুলশা প্রভৃতি।
দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ রেণু পোনা যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। চাঁচড়া হ্যাচারিপল্লীর ৮২টি হ্যাচারিতে গত বছর প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার কেজি রেণু উৎপন্ন হয়। চৈত্র থেকে মধ্য আষাঢ় রেণুপোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। পোনা চাষী চাচড়া পাওয়ার হাউজ মোড়ের রবিউল ইসলাম রবি বলেন, প্রথম দিকের বাজার ধরতেই তিনি ১০টি পুকুর রেডি করেছেন। পাবদা ও পাঙাশ রেনু থেকে পোনা করবেন তিনি। সাথে থাকবে রুই, কাতল, ব্লাক কার্প, পুটি, মিনার কার্প ও সিলভার কার্প রেনু পোনাকরণ।
যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়ন এলাকার ঘের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বলেন, এঅঞ্চলে আমার চারাপোনা উৎপাদনের ১০বিঘা জমিতে মাছের ঘের রয়েছে। এখান থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাপারী এসে চাহিদামত নিয়ে যেত। এতে বেশ লাভবান হলে করোনা মহামারির পরবর্তী সময় থেকে প্রচুর লোকসান গুনতে হচ্ছে।
করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ১০বিঘা ঘেরে চারাপোনা উৎপাদনে ১৭-১৮ লাখ টাকা ব্যায় করে ২৪-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যেত। আর এখন খরচের টাকা টাও ওঠানো সম্ভব হয়না। বরং কিছু ঘাটতি থেকে যায়। অন্যদিকে মাছের খাদ্য, খৈল, ভূষি ইত্যাদির দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় আসল টাকা তুলতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কিসমত নওয়াপাড়া এলাকার আরেক পোনা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম (রাখাল সাইফুল) জানান, এব্যবসা এখন বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে কিন্তু বছর চুক্তিতে ঘের নেয়ার কারনে ছেড়ে যেতেও পারছিনা। হঠাৎ ব্যবসা মন্দার কারন অদৃশ্য মহামারী।
অন্যান্য ব্যবসার মত এ ব্যবসাও থমকে গেছে। বাইরের ব্যাপারী না আসলে এই আর মন্দা কাটিয়ে ওঠা সম্ভবনা। তার উপর মৎস খাদ্যের দাম হঠাৎ করে কেজিতে ৫-৭ টাকা হারে বেড়ে গেছে। সরকারের কাছে দাবী এই খাতে সরকারী-বেসরকারী সংস্থার সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রদান করা হোক। যেন আমরা এ মৎস ঘের এর মাছে পোনা উৎপাদন সচল রাখতে পারি।
এ ব্যাপারে যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অনিচ্ছুর রহমান জানান, এখানে ৭০ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। জেলাটি মাছ উৎপাদনে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। প্রথম স্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা। বছরে ৫শ’ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হচ্ছে যশোরে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম জানান, যশোর মৎস্য চাষে অনেক আগ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এখানকার মাটি ও পানি মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। যে কারণে ভালোমানের মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে।