করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ বা ‘লকডাউনে’ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু থাকলেও পবিত্র ঈদুল আজহার পর সেটি হচ্ছে না। ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিন পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হবে।
আজ মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপনে এমন নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদ–পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই, অর্থাৎ কাল বুধবার মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ছয়টা পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো। এরপর থেকেই, অর্থাৎ ২৩ জুলাই সকাল ছয়টায় আবার কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হবে। চলবে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত। ঈদের পর শুরু হওয়া এই কঠোর বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে।বিজ্ঞাপন
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ওই মাসের শেষ দিকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তখন অনেক কারখানা বন্ধ করলেও কিছু খোলা ছিল। পরে হঠাৎ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা খোলার ঘোষণা দিলে শ্রমিকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে, রিকশা–ভ্যানে চড়ে কারখানায় পৌঁছান শ্রমিকেরা। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে আবার কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হন মালিকেরা। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে কারখানা আবার খুলে দেওয়া হয়।
চলতি বছরের এপ্রিলে সরকার আবার বিধিনিষেধ দিলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা উৎপাদন চালানোর সুযোগ পায়। সর্বশেষ গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত ও পরে ১ জুলাই থেকে চলমান কঠোর বিধিনিষেধেও পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু রয়েছে।বিজ্ঞাপন
ঈদের পর সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তে পোশাকশিল্পের মালিকেরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বলে জানালেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুন, জুলাই ও আগস্টে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করি আমরা।অন্যদিকে বর্তমানে বিপুলসংখ্যক ক্রয়াদেশ পাচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে ঈদের পর দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ রাখলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ বাতিল করতে পারে। কারণ, ইউরোপ–আমেরিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। পোশাকের ব্র্যান্ডের দোকানে বিক্রিও বেড়েছে। ফলে তাদের বর্তমানে প্রচুর পোশাক দরকার।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর এই সহসভাপতি বলেন, ‘ঈদের আগে আমাদের কারখানাগুলো ১৯ জুলাই ছুটি হয়ে যাবে। অধিকাংশ কারখানাই সাত দিনের ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সরকার ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখার বাস্তবতা বর্তমানে নেই। আশা করি, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
করোনার চ্যালেঞ্জে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের পোশাকের প্রচুর ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। ইতিমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠান আগামী মার্চ পর্যন্ত তাদের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রয়াদেশের বুকিং পেয়ে গেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
পোশাকশিল্পের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানালেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। ফলে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমে ভালো বিক্রির প্রত্যাশা করছে। সে জন্যই প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার জন্য কিছু ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হয়েছে এ দেশে। এর আগ থেকেই চীনের ক্রয়াদেশও বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আসছিল। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে যখন করোনা ছিল না, তার তুলনায় বর্তমানে ৫-১০ শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ আসছে। তাতে কারখানায় শ্রমিক নিয়োগও বেড়েছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের জট ও দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন রপ্তানিকারকেরা।
গ্রীষ্ম ও বসন্তের আগে রয়েছে শীত মৌসুম। এই মৌসুমের ক্রয়াদেশও মোটামুটি ভালো পাওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি গত এপ্রিল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। গত মাসে শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের (২ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা) পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি কমে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলার হয়েছিল। ওই বছরের শেষ তিন মাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হলেও সদ্য বিদায়ী অর্থবছর পুরোটাই ছিল করোনাময়। তারপরও বিদায়ী অর্থবছরে ভালো করেছে বাংলাদেশ।