আজ - রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - সন্ধ্যা ৭:১০

(এমসি)কলেজের অপকর্মের হেডকোয়ার্টার ২০৫ নং কক্ষ

অপকর্মের স্থল ২০৫ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষ হচ্ছে সব অপরাধের হেডকোয়ার্টার। সন্ধ্যা নামলেই এই কক্ষেই ছুটে আসতো বখাটে ছাত্রলীগ কর্মীরা। মাদক সেবন, নারীর সঙ্গ সবই হতো এই কক্ষে। সবই দেখতেন আশেপাশের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করতেন না। এমনকি ফিরেও চাইতেন না এই কক্ষের দিকে। ওখানে যা হতো সব যেনো বৈধ। সিলেট এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাস। ৮ বছর আগে এই ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। এরপর সরকারের তরফ থেকে এমসি’র এই ছাত্রাবাসকে আগের আদলেই পুনঃনির্মাণ করা হয়। এখনো নির্মাণাধীন ওই ভবন। তবে চার বছর আগে থেকেই এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ হলের দু’তলা এবং তিন তলায় ছাত্র তুলেছে। প্রতি তলায় বসবাস করেন ৩৬ জন ছাত্র। নিচে ডাইনিং। চতুর্থ তলাটি এখনো নির্মাণাধীন। ছাত্ররা বসবাস করলেও নবনির্মিত হলের বাইরে এখনো বিদ্যুতায়ন হয়নি। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার হয়ে পড়ে এলাকা। হলের নিচ তলা থেকে দু’তলায় উঠলেই বাম পাশে পড়ে আলোচিত ২০৫ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষেই বাস ছাত্রলীগের ‘ভয়ঙ্কর’ কর্মী শাহ মাহবুবুর রহমান রনির। তার নামেই এই হলটি বরাদ্দ। গত বছর সে এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করলেও হলের ওই রুম ছাড়েনি। এখনো রুমটি তার নামেই বরাদ্দ। জোরপূর্বক কক্ষটি দখল করে অপরাধ আস্তানায় পরিণত করেছে সে। তার ভয়ে তটস্থ থাকেন হলের অন্য ছাত্ররা। বছর দু’এক আগে ওই কক্ষে এক ছাত্রকে নিয়ে টর্চার করা হয়েছিলো। এরপর থেকে রনির কক্ষটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের নাম ছিল। হলে বসবাসকারী কয়েকজন ছাত্র জানিয়েছেন, মার্চ মাস থেকে হল বন্ধ। কিন্তু শাহ রনি তার কক্ষেই বসবাস করছিলো। তার জন্য খোলা ছিল হলের ডাইনিংও। মার্চ থেকে হল সুপাররা থাকেন না। এ কারণে হলের নিয়ন্ত্রণ করে সে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। বরং তারা যেসব কর্মকাণ্ড করে সব যেনো বৈধ। ২০৫ নম্বরে সব সময় আড্ডা দিতো রনি, সাইফুর, রবিউলসহ সব ধর্ষক। তারা ওই কক্ষে বসেই ইয়াবা সহ নানা মাদক সেবন করতো। আড্ডা দিতো, চিৎকার করতো। যখন যা ইচ্ছা তখন তাই করেছে। সন্ধ্যার পর মাঝে মধ্যে তারা হলের বাইরে খোলা জায়গায় অবস্থান নিতো। অন্ধকারময় ফাঁকা স্থান। ওখানে বসে তারা মাদক সেবন করতো। পাশেই বালুচর, টিলাগড়। ওখান থেকে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীরা যেতো। তাদের নিয়েও আড্ডা হতো। মূলত রনির অবস্থানের কারণেই বাইরের ছাত্রলীগ কর্মীরা বাধা ছাড়াই হলে প্রবেশ করতো। দারোয়ানরাও থাকতো তাদের ভয়ে তটস্থ। শুক্রবার হলের সামনে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার সময় দারোয়ানরা সব দেখলেও প্রতিবাদ করেনি। বরং তারা ঘটনাটি দেখেও দেখেনি বলে জানায়। ধর্ষণের ঘটনার পরপরই হলে ছুটে যান কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তারা জানিয়েছেন, হলের সামনে পুরোটাই অন্ধকার। এ ছাড়া ওখানে বখাটেরা আড্ডা দেয়। তারা প্রায়ই সন্ধ্যায় হলের বাইরে ছিনতাই করে। পাশের টিলায় বেড়াতে আসা নারীদের উত্ত্যক্ত করে। কখনো কখনো ধর্ষণ করেছে। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। ঘটনার পর রাতেই সিলেটের শাহপরান থানার পুলিশ হলের আলোচিত সেই ২০৫ নম্বর কক্ষে অভিযান চালায়। সেখান থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, হলের শাহ রনির কক্ষ ছিল সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে পুলিশের তরফ থেকে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়। শিক্ষক বাংলোতে থাকতো সাইফুর: সিলেটের শাহপরান হলের ৪ নম্বর ব্লকে রয়েছে টিচার্স বাংলো। ওই বাংলোতে হলের দায়িত্বরত শিক্ষকদের থাকার কথা। কিন্তু বাংলোতে শিক্ষকরা থাকতেন না। ওই বাংলোটি দখলে ছিল ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমানের। ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর ক্যাডার সাইফুর। টিলাগড়ের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকারের গ্রুপের কর্মী সে। শাহ রনি, মাহফুজ, রবিউল, অর্জুন সহ সবার নিয়ন্ত্রক সে। শিক্ষক বাংলো সাইফুর দখলে রাখলেও শিক্ষকরা কখনোই প্রতিবাদ করেননি। বরং তারা নীরব থেকেছেন। ঘটনার দিন শিক্ষক বাংলোতে ওই গৃহবধূকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এদিকে হলে বসবাসরত কয়েকজন ছাত্র জানিয়েছেন, শিক্ষক বাংলোতে রাজার হালে বসবাস করতো সাইফুর। রাত হলেই বাংলোতেও সে অপকর্ম করতো। প্রায় সময় অচেনা নারীরাও তার বাংলোতে আসতো। সিলেটের টিলাগড়ের সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী মুন্না আহমদ জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে সাইফুরের নেতৃত্বে এমসির ফটকে তার মালিকানাধীন দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও ক্যাশ লুট করেছিলো। ওই সময় তিনি সাইফুর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা দায়ের করলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেনি। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এমসি কলেজের অভ্যন্তরে মাদক, জুয়ার আড্ডা বসিয়েছিলো সাইফুর ও রনির নেতৃত্বে ক্যাডাররা। এসবের প্রতিবাদ করার কারণে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের উপরই তারা সশস্ত্র অবস্থায় একাধিক বার হামলা চালায়। ঘটনার দিন পুলিশ শিক্ষক বাংলো থেকে সাইফুরের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। ওই আগ্নেয়াস্ত্র সাইফুর এমসি কলেজে সংঘর্ষে ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া টিলাগড়, বালুচর, নতুন বাজার, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। ওই সব এলাকায় বেড়াতে যাওয়া লোকজনের সর্বস্ব ছিনতাই করতো তারা। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন আহমদও স্বীকার করেছেন তার অসহায়ত্বের কথা। তিনি জানান, হোস্টেলের সামনে বিদ্যুতের বাতি ছিল। কয়েকটি বাতিই কে বা কারা নষ্ট করে ফেলে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার জানিয়েছেন, হল থেকেই অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ কারণে শাহ রনি, সাইফুর সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।

আরো সংবাদ