দেশে করোনা সংক্রমণের শনাক্তের হার কমেনি। এখনো প্রতিদিনই ১০ শতাংশের উপর রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ একইভাবে চলছে। প্রথম ঢেউই চলমান। বাংলাদেশে করোন নিয়ন্ত্রণ হয়নি। কয়েকগুণ রোগী অ-শনাক্ত থেকে যাচ্ছে। এরমধ্যেই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণে কাবু।
সংক্রমণ বাড়ায় নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ক্রমে স্থবির হয়ে পড়ছে জনজীবন। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। কোটি কোটি মানুষের ওপর আবারো কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। এর ফলে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ আবারো প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। দেশে গ্রীষ্মকালের পর আবহাওয়া শীতল হলে এই মহামারি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপে এক সপ্তাহে করোনা রোগীর সংখ্যা ৪৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। কোয়ারেন্টিন না মানায় সংক্রমণ বাড়ছে বলে সংস্থাটি মনে করছে। এটা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয় মন্তব্য করে সংস্থাটি বলছে, কয়েক মাসের মধ্যে ইউরোপে গত এপ্রিলের পিকের (চূড়া) তুলনায় মৃত্যু ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
সরকারি হিসাব মতে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজারের কাছাকাছি। শনাক্তের সংখ্যা ৪ লাখের কিছু কম। দেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয় আর প্রথম মৃত্যু ১৮ই মার্চে। প্রথম থেকেই করোনার থাবা ঢাকাতে। হটস্পট ছিল রাজধানী। দিনে দিনে সারা দেশে ছড়ালেও রাজধানীতেই অর্ধেকের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো শিথিল হওয়ায় রাজধানীতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মত, মানুষের মধ্যে সর্বজনীনভাবে মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো এবং পরীক্ষা ও আইসোলেশনের মতো স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগের ওপর এ রোগের বিস্তার অনেকটা নির্ভর করবে। করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো টিকা না আসা পর্যন্ত এ মহামারি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম উল্লেখ করে আগামী শীতকালে বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, ভিটামিন ডি-এর অভাব এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয় বলে এসময় মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠতে পারে।
করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণে আমরা এখনো প্রথম ঢেউয়ের মধ্যেই আছি। কারণ দেশে প্রতিদিনই ১০ শতাংশের উপরে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। করোনা সংক্রমণ শীতে বাড়লে দ্বিতীয় ঢেউ বলা যাবে। শীতে করোনা বাড়া মানে দ্বিতীয় ঢেউ। বুধবার জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির একটি সভা হওয়ার কথা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, শীতে করোনা বাড়লে কি করণীয় হবে তা নিয়ে মিটিংয়ে আলোচনা করা হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। দেশে প্রথম ঢেউই এখনো চলমান। এটাই আরো বাড়তে পারে। যদি শনাক্ত ৫ শতাংশের নিচে আসে তখন বলা যাবে করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, শীতে ঠাণ্ডাজনিত রোগে মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে। এই সময়ে সংক্রমণ বাড়ার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে তিনি মনে করেন।
দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের করোনা সংক্রমণ এখন বাড়েনি। সামনে ভয় আছে। ডিসেম্বরে করোনার সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা দেখছেন তিনি। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, আমাদেরকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে কাবু ইউরোপ: শীতের মাসগুলোতে করোনা সংক্রমণ বাড়বে, এমন পূর্বাভাস সত্ত্বেও ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক দেশে লকডাউন ঘোষণা করতে হচ্ছে। সোমবার আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলস করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আবার লকডাউন ঘোষণা করেছে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন বুধবার রাত থেকে ‘স্টে অ্যাট হোম’ নির্দেশ কার্যকর করছেন। সরকারি এই বিধিনিয়মের আওতায় অতি প্রয়োজনীয় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্র বন্ধ থাকবে। তবে স্কুল খোলা রাখা হবে। বৃটেনের ওয়েলস প্রদেশে দুই সপ্তাহের জন্য ‘ফায়ারব্রেক’ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। ফলে অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। ঘরে-বাইরে মানুষের মেলামেশাও সীমিত রাখতে হবে। জার্মানির বাভেরিয়া রাজ্যের একটি জেলায় লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে। ফলে ব্যারশ্েটসগার্ডেনার লান্ড এলাকার মানুষ মঙ্গলবার থেকে দুই সপ্তাহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবেন নন।
বেলজিয়াম সোমবার থেকে এক মাসের জন্য বার ও রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে সে দেশের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ইতালিও একই পদক্ষেপ নিয়ে মানুষকে যতটা সম্ভব ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। পোল্যান্ডের প্রায় অর্ধেক অংশ ‘ রেড জোন’ হয়ে ওঠায় রাজধানী ওয়ারশ’র জাতীয় স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডে বদ্ধ জায়গায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। গত সপ্তাহান্ত থেকে প্যারিসসহ ফ্রান্সের নয়টি শহরে সারারাত কারফিউ জারি করা হচ্ছে।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে আরো ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ হাজার ৬৯৯ জনে। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৮০ জন। এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৮৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৪২ জন এবং এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৭ হাজার ১৪১ জন সুস্থ হয়েছেন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা সংক্রান্ত নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, দেশে ১১০টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৬০টি। নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬১১টি। এখন পর্যন্ত ২১ লাখ ৯২ হাজার ৩২৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৭৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ এবং ৪ জন নারী। এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৮৫ জন পুরুষ এবং ১ হাজার ৩১৪ জন নারী মারা গেছেন। বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের উপরে ১১ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫ জন এবং ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। বিভাগ বিশ্লেষণে ঢাকা বিভাগে ১২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন, খুলনা বিভাগে ১ জন এবং রংপুরে ২ জন রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১৫৫ জনকে। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১২ হাজার ২২৪ জন। আইসোলেশন থেকে ২৪ ঘণ্টায় ১৩৮ জন এবং এখন পর্যন্ত ৭২ হাজার ২৬০ জন ছাড় পেয়েছেন। এ পর্যন্ত আইসোলেশন করা হয়েছে ৮৪ হাজার ৪৮৪ জনকে। প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টিন মিলে ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে ৭৩০ জনকে। কোয়ারেন্টিন থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৭৪ জন এবং এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ৩৬৩ জন ছাড় পেয়েছেন। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৮৯ জনকে। বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ৩৯ হাজার ৮২৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রান্ত ফোনকল এসেছে ৪১ হাজার ২৬৭টি এবং এ পর্যন্ত মোট ফোনকল সংখ্যা ২ কোটি ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ১৩০টি।