বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে জরুরী খাদ্য সহায়তা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’।
এটুআই প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরফে এলাহি বাসসকে জানান, ‘এই হেল্পলাইনটি মূলত সরকারি সেবা প্রাপ্তি, কর্মকর্তাদের তথ্য, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার প্রতিকার এবং পর্যটন ও জেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল চালু করা হয়। কিন্তু দেশে করোনা ভাইরাস মহামারী শুরুর পর এটিকে জরুরী করোনা হেল্পলাইনে পরিণত করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহযোগিতায় এটুআই-এর তৈরি এই জাতীয় হেল্পলাইনকে জরুরী করোনা হেল্পলাইন হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই হেল্পলাইন জনগণকে করোনা ভাইরাসসহ স্বাস্থ্যবিধি এবং করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে করণীয় বিষয়ে তথ্য প্রদান করে আসছে।
এটুআই কর্মকর্তা আরো বলেন, ’৩৩৩’ এর কলে সাড়া দিয়ে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে।জাতীয় হেল্পলাইনকে জরুরী করোনা হেল্পলাইন হিসেবে ব্যবহারের জন্যে এর সাথে মোবাইলে স্বাস্থ্যসেবা (টেলিমেডিসিন) প্রদানেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ই-লার্নিং প্লাটফর্ম ’মুক্তপাঠের’ মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর উপর কোর্স সম্পন্নকারী সাড়ে চার হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত চিকিৎসককে নিয়ে একটি ডক্টর’স পুল এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
এ উদ্যোগের শুরু থেকেই ’৩৩৩’ এর সাথে যুক্ত ডাক্তাররা মোবাইলে রোগীর সাথে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে আসছেন। মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে করোনা উপসর্গ-সম্পন্ন রোগীদের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ও দিয়ে আসছেন।
মিরপুরের অধিবাসী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি ১০৩ ডিগ্রি জ্বর ও কাশিতে ভুগছিলাম। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রদুর্ভাবের কারণে এ নিয়ে আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।জাতীয় হেল্পলাইনের স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে আমি সুস্থ্য হয়ে উঠেছি।’
তিনি জানান, সারাদেশে লকডাউনের কারণে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যাপারে তিনি একেবারেই অনিশ্চিত ছিলেন। একদিকে হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। অন্যদিকে ডাক্তারের স্বল্পতা। এমন সময় তিনি এটুআই’র জাতীয় হেল্পলাইনের মাধ্যমে টেলিমেডিসিনের বিষয়ে জানতে পারেন এবং সাথে সাথে ‘৩৩৩’ এ কল করে ডাক্তারের কাছে তার শারীরিক অবস্থার বিবরণ দেন।
মিজানুরের সমস্যাগুলো জেনে, ডাক্তার মিজানুর করোনায় আক্রান্ত নন বলে আশ্বস্ত করেন এবং মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ব্যবস্থাপত্র পাঠান।
মিজানুর বলেন, ‘আমি আশ্বস্ত হয়েছি যে, আমি করোনায় আক্রান্ত হইনি। তবে, ডাক্তার বলেছিলেন যদি এরপরও কোনো সমস্যা অনুভব করি তাহলে যেনো আবার ’৩৩৩’ এ কল করি,’।
এটুআই কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ৩ লাখেরও বেশি নাগরিক ‘৩৩৩’ এর মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করেছেন।
এটুআই প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা এলাহি বলেন, এই জাতীয় হেল্পলাইন দিনমজুর ও দুস্থ মানুষ যারা কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের জন্য জরুরী খাদ্য সহায়তা হেল্পলাইন হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। করোনা হেল্পলাইনের পাশাপাশি, এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ‘৩৩৩’ কে জরুরী খাদ্য সহায়তা হটলাইন হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘যেসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষ এবং দিনমজুর লকডাউনের কারণে কাজে যোগ দিতে না পারায় খাদ্যাভাবে পড়েছেন এবং যারা লজ্জায় লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ গ্রহণে অপারগ, তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এই হটলাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।’
এলাহি জানান, যদি কারো খাদ্যের প্রয়োজন হয়, তিনি দেশের যে কোনো প্রান্ত হতে ‘৩৩৩’ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চাইতে পারেন। সাথে সাথে ‘৩৩৩’ এর সেবা প্রদানকারীরা কলটি সংশ্লিষ্ট জেলা বা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্থানান্তর করে দেন। তখন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তথ্য যাচাই করে খাদ্যসামগ্রী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার কুদ্দুস মিয়া জানান, তিনি ছোট একটি চায়ের দোকান চালিয়ে সাত সদস্যের একটি পরিবার পরিচালনা করতেন। কিন্তু লকডাউনের জন্য তার চায়ের দোকনটি বন্ধ করতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে আমার চায়ের দোকানটি বন্ধ হওয়ার পর, আমার সব সঞ্চয় দিয়ে এক সপ্তাহের খাবার কিনতে পেরেছিলাম। অন্যদিকে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে গিয়েও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। এদিকে, এক সপ্তাহের খাবার শেষ হওয়ার পর কী করবো ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। এমন সময় জাতীয় হেল্পলাইন ’৩৩৩’ এ কল করে খাবার পাওয়া যায় জানতে পারি।’
তিনি জানান, বিষয়টি জানার পর ’৩৩৩’ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চাইলে হেল্পলাইনে থাকা সেবাদাতা তার কলটি ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে স্থানান্তর করে দেয়। কল পেয়ে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার কুদ্দুস মিয়ার বাড়ি গিয়ে এক মাসের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আসেন।
জাতীয় হেল্পলাইনের মাধ্যমে অভাবীদের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার এই উদ্যোগ গ্রহণ করায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কুদ্দুস মিয়া বলেন, ‘এই উদ্যোগটি গ্রহণ করার জন্য সরকার ও জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’ এর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো ভাষা আমার নাই।’
এটুআই এর তথ্যমতে, কুদ্দুস মিয়ার মত এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ লোক জাতীয় হেল্পলাইনে খাবারের জন্য কল করেছে। এর মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করে ৩ লাখ কল স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্থানান্তর করা হয়।
জাতীয় হেল্পলাইন সপ্তাহের ৭ দিন ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। সেখানে অনাবাসিক বাংলাদেশীরাও কল করে সাহায্য চাইতে পারেন।এই হেল্পলাইন চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৩২ লাখের বেশি লোক সেবা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সারাদেশে ১৮ হাজারের বেশি সামাজিক সমস্যা সমাধান হয়েছে এবং ৫ হাজার ৫ শ’ বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে। এছাড়াও, আরো কিছু নাগরিক সেবা এই হেল্পলাইনের সাথে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।