আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ১১:৫৭

কুষ্টিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের বাসিন্দারা এখন নতুন স্বপ্ন দেখছেন

মুজিবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়ে আশ্রয়হীন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ৫৩টি ঘরের বাসিন্দারা এখন যেন নতুন স্বপ্ন দেখছেন । তাদের চোখে এখন আনন্দের জল। সরজিমনে এমন অভিব্যক্তি জানালেন সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের দিনমজুর আওলাদ হোসেন ও উজানগ্রাম ইউনিয়নের বৃত্তিপাড়ার গৃহিনী জো¯œা খাতুন। 
তখন বেলা ১২ টা। আষাঢ়ের শেষ দিন। হাল্কা বৃষ্টি শেষে রোদ উঠেছে মাত্র। শহর থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। গড়াই নদীর উপর কুষ্টিয়াবাসীর স্বপ্ন শেখ রাসেল সেতু পার হয়ে বোয়ালদহ গ্রাম। দূর থেকে কলারবাগানের পাশে সাদা দেয়াল আর উপরে নীল রংয়ের করগেট টিনের পর পর দুটি ঘর চোখে পড়লো। ঘরের সামনে সদ্য স্থাপিত বিদ্যুত পোল থেকে সংযোগ গেছে দুটি ঘরে। সামনে যেতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মাঝ এক বয়সী ব্যক্তি। নাম জানতেই বলে উঠলেন, আওলাদ হোসেন। পেশায় একজন দিনমজুর। সাথে স্ত্রী ফাতেমা খাতুনও রয়েছেন। আগে তাদের কোন ঘর ছিল না। কখনও চরের জায়গায়, কখনও স্কুল ঘরের বারান্দায়, কখনও বাজারের পাশে অন্যের জমিতে ঘর করে তাদের দিন চলতো। আওলাদ হোসেন পেশায় দিনমজুর। স্ত্রী গৃহিনী। দিন আনে দিন খায়। যা আয় করেন তাতে তিন বেলা মুখে খাবার জোটে। ঘর তোলাতো দূরের কথা, জমি কেনারও টাকা নেই। কেমন আছেন, কে দিলেন ঘর ও জমি। এমন প্রশ্নে আওলাদ হোসেন জানালেন, অনেক দিন থেকে সে শুনছে, সরকার থেকে ঘর দিচ্ছে। কে দেবে তাকে ঘর, কিভাবে পাবে সে ঘর। তার তো জমি নেই। চেয়ারম্যান ‘চাচ্চু’র বউ’র কাছে যায়। তার মত অনেকে তার কাছে যায় ঘরের জন্য। তার পর ছবি, ভোটার কার্ড জমা দিয়েছে। শহর থেকে বেশ কয়েকবার অফিসার এসে তাদের খোঁজ খবর নিয়েছে। জমিসহ ঘর মালিক আওলাদ হোসেন ও মুরাদুল ইসলাম জানালো, তারা ধরেই নিয়েছিল ও সব ঘর টর তাদের হবে না, । যে জমিতে এখন ঘর এ জমি নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। পরে চেয়ারম্যান, টিএনও, এসিল্যান্ড অনেক যুদ্ধ করে জমি উদ্ধার করে তাদের ঘর করে দিয়েছে। আওলাদ,মুরাদ জানালো, কোন দিন ভাবতে পারিনি, জমিসহ তাদের ঘর হবে। প্রধানমন্ত্রী তাদের এমন উপহার দেবে স্বপ্নেও ভাবেনি। এ কথা বলতেই চোখে পানি এসে গেল দুজনের। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ব্রীজ হওয়ার আগে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের জমির তেমন একটা কদর ছিল না। ২০১৭ সালে হরিপুর গড়াই নদীর উপর শেখ রাসেল সেতু নির্মাণের পর এখানে জমির দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। এখন এক কাঠা জমির দাম এখানে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে, ভ’ুমিহীন, গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন প্রকল্পে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাধন কুমার বিশ^াস, সদর সহকারী কমিশনার (ভ’ুমি) এম, এ মুহাইমিন আল জিহান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সম্পা মাহমুদ ও সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান এক প্রকার যুদ্ধ করে জমি উদ্ধার করে জমিসহ তাদের ঘরের ব্যবস্থা করেছেন। কথা বলার প্রাক্কালে আওলাদ হোসেন ও মুরাদুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন। সেখান থেকে ফিরে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্পট সদর উপজেলার উজান গ্রাম ইউনিয়নের বৃত্তিপাড়ায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃত্তিপাড়া বধ্যভ’মি একটি নির্মম স্বাক্ষী। বধ্যভ’মি থেকে একটু ভেতরে এক টুকরো জমিতে দেখা গেল, সাদা দেয়ালের নীল করগেট টিনের একটি ঘর। ঘরের সামনেই যেতে বেরিয়ে এলেন পৌড়া জো¯œা খাতুন। স্বামী জালাল উদ্দিন বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। তার পর থেকে এখানে সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। জমিও নেই, ঘর নেই। স্কুলের বারান্দায়, বাজারের চালা ঘরের নিচে, তার রাত কাটতো। শুনতে পায় সরকার থেকে ঘর দিচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনেকবার গেছেন। অনেকের নামই নিয়েছেন। তার পর শহর থেকে লোক এসে তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে, আশপাশের লোকের সাথে কথা বলে তাকে ঘর দেয়ার কথা বলে। কিন্তু জমি নিয়ে অনেক ঝামেলাও হয়। সব ঝামেলা শেষে জোস্œা খাতুন ঘরে থাকেন, ঘরে রাত কাটান। এটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।  কিছুক্ষণ নিজের অতীত কথা বলতেই চোখে পানি চলে আসে। কেন কাঁদছেন জানতে চাইলে জো¯œা খাতুন জানান, এটা দুখের পানি না, এটা আনন্দের পানি। পরের বাড়ীর বারান্দায় থাকতে কত কথা শুনতে হয়েছে। কত দিন বৃষ্টিতে সারা রাত জেগে থেকেছে। এখন বেশ কয়েকদিন যা জোটে তাই খেয়ে আরামে ঘুমাতে পারেন। এ কথা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সে। 
তাদের মত কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ীর জাহিদা খাতুন, দিনমজুর আজিবর রহমান, ফকিরাবাদের দিনমজুর লিটন আলী, দিন মজুর কাবিল আলী, গোপালপুরের দিনমজুর সাহাবুল, গোপালপুরের দিনমজুর রমজান আলী, মাধবপুরের কৃষক শাহীন আলমের সাথে এমন কথাই জানা গেল। ঘরের মান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা এক সাথে বলেছে, টিএনও সাহেব, এসি ল্যান্ড, চেয়ারম্যান সব সময় খোঁজ খবর রাখতেন, কোন প্রকার খারাপ ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে ঘর করা যাবে না। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ৫৩টি ঘরের অধিকাংশই নির্মাণ শৈলী সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ীই করা হয়েছে। শক্ত, স্থায়ী ভাবে নির্মিত প্রতিটি ঘরে কোন প্রকার ফাটল, হেলে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়েনি। এ সব ঘরের বাসিন্দারা সকলেই এখন নতুন স্বপ্ন গড়ছেন। এ ব্যাপারে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা জানান, জমি নেই, ঘর নেই এই প্রকল্পে যত বার মিটিং হয়েছে। তত বার সংসদ সদস্য আমাকে বলেছেন, সার্বক্ষণিক তদারকি করতে। প্রায় প্রতিটি ঘর নির্মাণের শুরু এবং মাঝে ও শেষে সরজমিনে উপস্থিত হয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। চেষ্টা করেছি যাতে সেখানে কোন প্রকার অনিয়ম না হয়। তিনি জানান, জননেত্রী শেখ হাসিনা মুজিব বর্ষে এই সব গৃহহীন, ভ’ুমিহীন মানুষের কথা ভেবে এমন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। সেখানে অনিয়মের তো প্রশ্নই আসে না। বরং আমাদের সকলের উচিত সম্মিলিত ভাবে সহযোগিতা করা। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাধুন কুমার বিশ^াস জানান, আমি কুষ্টিয়ায় যোগদান করেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প মুজিববর্ষে ভ’মিহীন, গৃহহীনদের পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রতি গুরুত্ব বাড়িয়ে দেই। ৫৩টি ঘরের জন্য জমি উদ্ধারে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব, আমার এসি ল্যান্ড, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্পবাস্তবায়ন কর্মকর্তা যখন যে সময় যে সমস্যার কথা বলেছে, আমার সাধ্য অনুযায়ী আমি তা পূুরণ করার চেষ্টা করেছি। এ কাজটি একটি মহত কাজ।
 প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, মুজিবর্ষে ভ’মিহীন , গৃহহীন পুনর্বাসন প্রকল্প একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প কেননা নির্ধারিত বরাদ্দে এ বাজারে ঘর নির্মাণ বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার পরও উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও সাহেবের আন্তরিকাতায় এ প্রকল্প সদর উপজেলায় আসার পর থেকে আমরা জমির সন্ধানে নেমে পড়ি। জমি উদ্ধার যে কি ঝামেলা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জমির পর ঘর নির্মাণ। এ করোনাকালেও রাতদিন ঘরেরর তদারকিতে আমাকে মাঠে থাকতে হয়েছে। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে কোথায় ঘর হচ্ছে। সেখানে হাজির হয়ে কি দিয়ে কাজ করছেন, কিভাবে করছেন সকল কিছু তদারকি শেষে এখন নিজের কাছে এত ভালো লাগছে।

আরো সংবাদ