এম আহম্মেদ (যশোর থেকে) : যশোরে চিস্তি হযরত গরীব শাহ রহঃ বাৎসরিক ওরশ শরীফে অংশ নেওয়া শতাধিক ভক্ত, আশেকান ও মুরিদানের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করেছেন যশোর সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম।
আগামীকাল ১৪ ই মার্চ (২৯ ফাল্গুন ১৪২৭) যশোরে হযরত গরীব শাহ সড়কের বকুলতলা মোড় এলাকায় চিস্তি হযরত গরীব শাহ রহঃ মাজার শরীফের স্মরনে বাৎসরিক ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হবে। ওরশ শরীফ অনুষ্ঠানে ত্বরিকায়ে মাইজভান্ডারি মিলাদ মাহফিল দোয়া ও সামা কাওয়ালীর আয়োজন করা হবে।
সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলামের স্ব-উদ্যোগে বস্ত্র বিতরনের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, যশোর সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা মতলেব বাবু, যশোর জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক জাহিদ হোসেন মিলন, দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান, নওয়াপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক হুমায়ুন কবির তুহিন, যশোর জেলা আওয়ামী মৎসজীবী লীগের যুগ্ন-আহবায়ক ফিরোজ কবীর পিকুল, যশোর জেলা মৎস্যজীবীলীগ ও রামনগর আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা মাহমুদ হাসান লাইফ, কাশিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোঃ শরিফুল ইসলাম সহ ভক্ত আশেকান মুরিদান বৃন্দগন প্রমুখ।
আজ ১৩ ই মার্চ বিকাল ৪ টা থেকে শুরু করে রাতে দোয়া দুরুদ ও খাবার বিতরনের মধ্য দিয়ে আগামীকাল ১৪ ই মার্চ ওরশ শরীফ অনুষ্ঠান শেষ হবে। সভায় দীন ও ইসলামের দিক নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে বিশেষ আলোচনা করা হবে। মাইজভান্ডারি ও বিভিন্ন কাওয়ালী শিল্পীদের গানে মুখরীত হবে বকুলতলা মোড় এলাকায় চিস্তি হযরত গরীব শাহ রহঃ মাজার শরীফ এলাকা।
প্রখ্যাত ধর্মগুরু ও আধ্যাত্নিক সাধক হযরত গরীব শাহ (রহ:) এর আধ্যাত্ম সাধনা, অলৌকিক কাহিনী, সুগভীর পান্ডিত্বের কথা যশোরবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জানা যায় তাঁর পূর্ব পুরুষ বাগদাদের অধিবাসী। তাঁর পিতামহ কিতাব উদ্দীন বাগেরহাট, যশোর হয়ে মাগুরায় বসতি স্থাপন করেন। মাগুরা নৌহাটা গ্রামে গরীব শাহ দেওয়ানের জন্ম।
এলাকায় এখনো জনশ্রুতি আছে, একবার ব্রিটিশ সরকারের নীলকুঠি ইনচার্জ টমাস টুইডি এলাকার হাজরাপুর দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় হানু নদীর তীরে হজরত গরীব শাহকে দেখতে পেয়ে ভিক্ষুক ভেবে একটি মুদ্রা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মুদ্রাটি হাতে নিয়ে নদীতে ফেলে দেন। টমাস টুইডি এতে রেগে তাৎক্ষনিকভাবে মুদ্রাটি ফেরৎ চাইলে হজরত গরীব শাহ (র:) তাকে হাত পাততে বলেন। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, অসংখ্য মুদ্রায় তার হাত ভরে গেছে। টুইডি তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চান এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
ছোটবেলায় তিনি একই গ্রামের গগন মুন্সির বাড়িতে থেকে লেখাপড়া ও রাখালের কাজ করতেন। এলাকার অনেকেই গরীব শাহকে নিয়ে মালিকের কাছে নানা কথা বলত। একদিন গভীর রাতে গগন মুন্সী তাঁকে পাহারা দেয়ার জন্য ওৎ পেতে রইল। রাত যখন গভীর হয় তখন গগন মুন্সি দেখতে পেলেন বালক গরীব শাহ বিছানা ছেড়ে হানু নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনিও তাঁর পিছু নিলেন। তিনি দেখলেন, গরীব শাহ নদীতে ওজু করে খড়ম পায়ে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে নদীর ওপারে গেলেন। পরদিন তিনি তাঁকে বললেন, আজ থেকে আমি তোমার মনিব নই। এ বাড়িতে তোমার কোন কাজ করতে হবে না। তুমি কেবল বসে বসে খাবে আর ধর্ম পালন করবে।
একবার গরীব শাহের বাড়িতে মেহমান আসবে। মা তাঁকে বললেন, নদী থেকে কিছু মাছ ধরার জন্য। গরীব শাহ তখন ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে মাছ ধরার দোয়ার তৈরি করে নদীতে না বসিয়ে ডাঙায় বসিয়ে রাখলেন। এ দৃশ্য দেখে তাঁর মা এবং এলাকাবাসী তাঁকে বললেন, মানুষ পানিতে মাছ পায় না, আর তুমি ডাঙায় মাছ পাবে কী করে? এ কথার উত্তরে গরীব শাহ নাকি বলেছিলেন, নদীতে মাছ পাওয়া না গেলেও এ ডাঙায় ঠিকই মাছ পাওয়া যাবে। পরের দিন সকালে দেখা গেল যারা নদীতে দোয়ার পেতে রেখেছিল তাদের একটি দোয়ারেও মাছ নেই অথচ গরীব শাহ দেওয়ানের দোয়ারে অনেক মাছ আটকে রয়েছে। এছাড়া গাছের উপরে দোয়ার পেতে মাছ ধরা, নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কলেরা থামানো, হিংস্র বন্যপশুকে পোষ মানানোসহ নানা অলৌকিক ক্ষমতার কথা এখনো লোকমুখে শোনা যায়।
গরীব শাহকে মাত্র ছয়মাসেই বিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু বিয়ের পরপরই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এর পর তিনি আর কখনো সংসারের মায়ায় বন্দি হননি। ধর্ম প্রচারের মাধ্যমেই বাকি জীবন কাটিয়েছেন।
হযর ত গরীব শাহ (রঃ) হযরত খান জাহান আলী (র:) এর সহচর ছিলেন। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) বারোবাজার থেকে বাগেরহাটের দিকে যাত্রা করলে অসংখ্য ভক্ত তাঁকে অনুসরণ করেছিল। তিনি গরীব শাহ (র:) ও বাহরাম শাহ (র:) কে ইসলাম প্রচারের জন্য যশোরে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এই দুই শিষ্য যশোরের মুড়লীতে এসে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেছিলেন।
খান জাহান আলী (র:) ভৈরব নদীরতীরে প্রাচীন মুড়লীতে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। ক্রমে ক্রমে সেটি মুড়লী কসবা নামে পরিচিত হয়। কসবা শব্দের অর্থ শহর। মুড়লী কসবা ছিল সেই সময়কার শহর। গরীব শাহ মানুষকে ইসলামের আদর্শ বুঝিয়ে দিয়ে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতেন। হযরত গরীব শাহ (র:) ও হযরত বোরহান শাহ (র) এর চেষ্টায় পুরনো যশোর ঈশ্বরীপুর মুসলিম অধ্যুষ্যিত স্থানে পরিণত হয়েছিল। আস্তে আস্তে স্থানটি কসবা নামে পরিচিত হয় এবং তিনি এই কসবার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি একবার স্রোতবহ ভৈরব নদীকে রাগ করে ভৎসনা করেছিলেন বলে নদীর স্রোত স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল। জনসাধারণ বিশ্বাস করে যে, দরবেশের জন্যই নদীতে আজও স্রোত বহে না।
কথিত আছে যে, খান জাহান আলী (রঃ) তাঁর অন্যতম সঙ্গী হযরত গরীব শাহ (রঃ) কে তৎকালীন খরস্রোতা ভৈরব নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেতুটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হবার পূর্বেই তিনি মারা যান। এই সেতুকে আরবী/ ফারসী ভাষায় জসর বলা হয়। আর এ থেকে এলাকার নাম জসর (যশোর) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
হযরত গরীব শাহ (রঃ) ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দের পঞ্চম পাদের দিকে বাংলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, হজরত গরীব শাহ (র:) একই সাথে সাত জায়গায় দেহত্যাগ করেন। যে কারণে দেশের সাত স্থানে তাঁর মাজার রয়েছে। এর মধ্যে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নৌহাটা গ্রামে, যশোরের বকুলতলায়, ফরিদপুর, বারইঝুঁড়ি এবং বাকি মাজারগুলোর নাম তেমন জানা যায়নি। তবে যশোর এর কেন্দ্রস্থল দড়াটানা মোড়ের সামান্য পশ্চিমে ফৌজদারী কোর্টের উত্তরে বকুলতলায় ভৈরব নদীর তীরে তাঁর মূল সমাধি। সমাধিটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ন্যায় দেখতে। মূল্যবান রঙ্গীন বস্ত্র দ্বারা তাঁর সমাধি সব সময় আবৃত থাকে। ছোট মাজারটি বেশ পরিপাটি ও সুন্দর। সর্বদা ভক্তরা এখানে আনাগোনা করে, গরীব শাহের নামে সিন্নি মানত করে।
ইসলাম প্রচারক হিসাবে তিনি আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তিনি মরেও অমর।