সাইকেল-ভ্যানে বাহারি ফুল নিয়ে বাজারে এসেছেন চাষিরা। তাদের কারও কাছে গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা কারও কাছে জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকাসহ বাহারি সব ফুল। দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যাপারীরা সেই ফুল কিনছেন। ফুলবেঁচাকেনার এমন হাকডাক যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠা ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালিতে। হঠাৎ গরম পড়ায় ফুল ফুঁটে যাওয়া বাজারে ফুলের জোগানও বেশি। গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, চন্দ্র মল্লিকা, গাঁদা ফুলের দাম কিছুটা কম হলেও উর্ধ্বমুখী গোলাপের দাম। মাত্র দুই দিন আগেও যে গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে ৫ টাকায়। সেই গোলাপ শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। চাষিদের দাবি, বসন্ত, ভালোবাসা ও আন্তজার্তক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে বাড়তে শুরু করেছে ফুলের দাম। সামনের দিনগুলোতে ফুলের দাম আরও বাড়বে এবং তারা লাভবান হবেন।
একশ’ পিচের আঁটি বেঁধে ১৩ আঁটি গোলাপ নিয়ে এসেছেন পানিসারার হাঁড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান। একটি সাইকেলের পিছনে বেঁধেই বিক্রির জন্য গদখালি বাজারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। গলায় মাফলার পেছানো আর হাতে সিগারেট। মাঝে মধ্যে সিগারেট ফুঁকছেন আর কাছে আসা ব্যাপারীর সাথে দাম কষাকষি করছেন। ব্যাপারীর দাম পছন্দ না হওয়াতে গোলাপগুলো ছাড়লেন না তিনি। আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এ বছর ফুলের তেমন দাম নেই। দুই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি। আজ বাজারে ১৩ শ’ পিচ ফুল এনেছি। এর মধ্যে ৭টাকা পিচ ধরে এক হাজার গোলাপ ৭ হাজারে বিক্রি করেছি। বাকী তিনশ’ গোলাপ একটু কম বলছে, তাই দেয়নি। এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ফুলে একটু লসে আছি। তবে আশা করছি সামনের অনুষ্ঠানগুলোতে ভালো দাম পেলে লাভবান হতে পারব।’
জালাল হোসেন নামে অপর এক চাষি বলেন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে ফুলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যে গোলাপ ৩ থেকে ৫ পাঁচ টাকা গত চার দিন আগে বিক্রি করেছি; সেই গোলাপ আজ ৭ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জারবেরা বিক্রি করেছি ১০ থেকে ১৫ টাকা ও চন্দ্রমল্লিকা দুই তিন টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো দাম পাব’।
আকবর হোসেন নামে আরেক চাষি বলেন, ‘প্রথম দিকে গোলাপের দাম বেশ কম পাচ্ছিলাম। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দাম বাড়ছে। ক্ষেতে যে ফুল রয়েছে, তা আগামীতে ১৫-১৬ টাকা দরে বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’ গোলাপের দাম মূলত সাইজ, রঙ ও সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে বলে তিনি জানান। গদখালীর টাওরা গ্রামের ফুলচাষি কামাল সরকার বলেন, ‘আমার কাছে যে চায়না গোলাপ রয়েছে, তার দাম প্রতি পিস ২৫ টাকা। দেখতে সুন্দর ও বেশ কয়েক দিন রাখা যায় বলেই এর দাম বেশি। ২৫ কাঠা জমিতে রয়েছে চায়না গোলাপ। আশা করছি ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে ৩০ টাকার বেশি দাম পাবো এই গোলাপের।’
উৎসবের বাজার ধরতে গোলাপের কলিতে ক্যাপ
বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। ফুল চাষিরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোলাপ ফুল বিক্রি করে বাড়তি টাকা রোজগার করেন। তবে মাঘেও শীত নেই। অনুভূত হচ্ছে গরম। এই গরমে ফুল সময়ের আগেই ফুটে যাচ্ছে। তাই দ্রুত ফুল কেটে ফেলতে হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফুলচাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে ফুল চাষিরা তাদের ফুল সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করছেন ক্যাপ। যাতে আগাম ফুল ঝরে না পড়ে সেজন্য ফুলের কলি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ পড়িয়ে দিচ্ছেন। আগামি ১২ ফেব্রয়ারি সকাল থেকেই ফুল কাটা হবে। কিছু ফুল কাটা হবে বসন্তের দিন সকালে। আগাম ফুল কেটে রাখলে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এর চাহিদা যেমন থাকে না, তেমনি দামও পাওয়া যায় না। এজন্য যেন কলি না ফোটে এবং পাতা ঝরে না পড়ে সেজন্য তারা কলিতে ক্যাপ পরিয়ে দেন।
পানিসারা এলাকার নীলকন্ঠ নগরের ফুলচাষি ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আড়াই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি। ফুল ফুঁটেছে অনেক। তবে এখন ফুল কাটলে দাম বেশি পাবো না। তাই ফুলের কলিতে ক্যাপ পরিয়ে রাখছি। তিনি বলেন, আগে আমরা রাবার দিয়ে কলি বেঁধে রাখতাম। এতে করে ফুলের পাতা নষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে ক্যাপ পদ্ধতি ব্যবহার করছি। বিক্রি করার আগ পর্যন্ত কলিতে ক্যাপ পরানো থাকে। এতে ফুলের পাতা যেমন ঝরে পড়ে না, তেমনি ফুল নষ্টও হয় না। গত কয়েক বছর বছর ধরে তিনি ও এ এলাকার চাষিরা এভাবে ফুলের কলিতে ক্যাপ পরিয়ে রাখছেন বলে জানান।’
ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ফুলের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আসন্ন তিনটি বিশেষ দিবস ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। কোন দুর্যোগ এবং ধর্মীয় কোন প্রভাব না পড়লে অন্তত শত কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশাবাদী তারা।’
আসন্ন বসন্ত, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ব্যাপক ফুল বিক্রি হলে চাষিদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গদখালী ও পানিসারা এলাকার প্রায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করেন প্রায় চার হাজার চাষি। তাদের নিরাপদ জৈব বালাইনাশক ব্যবহার, শেড তৈরিসহ বিভিন্ন রকমের সাপোর্ট আমরা দিয়ে আসছি। সরকারকে জানিয়েছি, ফুলের বিকল্প ব্যবহারের নিমিত্তে কিছু প্রকল্প যাতে নেয়া হয়। বিদেশে যেমন ফুল দিয়ে নানা প্রসাধন, সৌরভ ইত্যাদি তৈরি করা হয়; তেমন কিছু যাতে আমরা এখানেও করতে পারি।