আজ - রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ৮:১৫

তিন তালাক প্রথা অবৈধ

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মুসলিম সমাজে তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাত্ক্ষণিকভাবে স্ত্রীকে ত্যাগ করার যে রীতি প্রচলিত রয়েছে, তাকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে দেশটির পার্লামেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই রায় দেন। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান, শিখ ও জরথুস্ত্র—ভারতের প্রধান এই পাঁচ ধর্মবিশ্বাসের পাঁচজন বিচারক এই প্যানেলে ছিলেন।

আদালতের এ রায়কে অভিনন্দন জানিয়েছে অনেকেই, তাদের মধ্যে ‘তিন তালাকের’ মাধ্যমে সংসার হারানো বেশ কয়েকজন মুসলিম নারীও রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই রায় ঐতিহাসিক উল্লেখ করে ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘এই রায় মুসলিম নারীদের সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করল এবং তাদের ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে। ’

পাঁচ বিচারকের মধ্যে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর ও বিচারপতি এস আবদুল নাজির তিন তালাক প্রথাটি ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সেই সময়ের মধ্যে সরকারকে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি তিন বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ, রোহিন্তন এফ নারিম্যান ও উদয় উমেশ ললিত তিন তালাক প্রথাকে ‘অসাংবিধানিক’ ও ‘কোরআনবিরোধী’ ঘোষণা করে রায় দেন। তাই শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায়ই আদালতের রায় বলে গণ্য করা হয়। এখন থেকে ভারতে তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, তিন তালাক প্রথাটি ধর্মীয় ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় এবং এটি সংবিধানের লঙ্ঘন।
আর রায়ের পর্যবেক্ষণে পাকিস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশের আইন উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেসব দেশে তিন তালাকের অনুমোদন নেই; তাই স্বাধীন ভারতেও এই প্রথা থাকা উচিত নয়।

তিন তালাক ইসলামের মৌলিক বিধান কি না এবং এর কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা আছে কি না তা এই প্রথমবারের মতো পর্যালোচনা করে দেখেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। পাঁচজন বিচারকের মধ্যে তিনজন বলেছেন, মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের কোথাও তিন তালাকের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এই প্রথা কোরআনের বিধান লঙ্ঘন করে।

তিন তালাক নিয়ে ভারতে বিতর্ক অনেক দিনের। তবে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মুসলিম নারী সংগঠন এবং কয়েকজন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীর দায়ের করা মামলাগুলোর কারণে তিন তালাক প্রথা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তিন তালাক নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে দাবি করে এই প্রথা তুলে দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা। এবার রায়ের মাধ্যমে আদালতও তাতে সায় দিলেন।

রায় ঘোষণাকালে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর বলেন, ‘এটা খুবই সংবেদনশীল মামলা, যেখানে অনুভূতির যোগ আছে। আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে উপযুক্ত আইন তৈরির বিষয়টি বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছি। ’

সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন না হলেও তিন তালাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। তিন তালাককে ‘বাজে বিধান’ আখ্যা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘আমরা আশা করি, আইন তৈরির সময় পার্লামেন্ট মুসলিম পারিবারিক আইনের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। সব পক্ষকে রাজনীতিমুক্ত হয়ে নতুন আইনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সময় মুসলিম সংগঠনগুলোর উদ্বেগ ও আপত্তিগুলো যেন খতিয়ে দেখা হয়। ’

ভারতীয় মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিধানগুলো দেখভালকারী বেসরকারি সংস্থা অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (এআইএমপিএলবি) তিন তালাকের ওপর যেকোনো নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে বলে আসছিল, এটি আদালতের বিষয় নয়, ধর্মীয় বিষয়। তাদের সুপারিশ ছিল, যারা টেলিফোনে তিন তালাক উচ্চারণ করে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে বা মুঠোফোনে তিনবার তালাক লিখে পাঠাচ্ছে অথবা চিঠি মারফত, তাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো দরকার। তাদের সামাজিকভাবে বয়কটও করা যেতে পারে। কিন্তু তিন তালাক প্রথা তুলে দেওয়া ধর্মবিরোধী হবে।

তিন তালাকপ্রাপ্ত সায়রা বানুর আইনজীবী বালাজি শ্রীনিবাসন বলেন, ‘সায়ারার স্বামী এক খণ্ড কাগজে তালাক শব্দটি তিনবার লিখে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। আমরা আদালতকে বলেছি, আইন বা কোরআনে এই প্রথার কোনো ভিত্তি নেই। ’

শুধু সায়রা বানু নন, আফরিন রহমান, গুলশান পারভীন, ইশরাত জাহান ও আতিয়া সাবরি নামের কয়েকজন তালাকপ্রাপ্ত নারী যেসব পৃথক মামলা দায়ের করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে, সেগুলোকে একত্রিত করেই সাংবিধানিক বেঞ্চ এই বিশেষ মামলাটি হাতে নিয়েছিলেন। অনেক সংগঠন, সরকারি দপ্তর, জাতীয় নারী কমিশন ও অন্য ব্যক্তিরা এই মামলায় অংশ নিয়েছিলেন। যদিও মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত তালাক প্রথা নিয়ে এই মামলা; কিন্তু এক হিন্দু নারীর দায়ের করা একটি মামলা চলাকালীন এর সূত্রপাত হয়েছিল।

কর্ণাটকের বাসিন্দা এক হিন্দু নারী তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পেতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। সেই মামলার শুনানি চলার সময়ই ওই নারীর বিরোধীপক্ষের আইনজীবী মন্তব্য করেছিলেন যে আদালতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় নিয়মে এমন অনেক কিছু রয়েছে যেগুলোও মুসলমান নারীদের অধিকার হরণ করে। ওই মন্তব্যের পরেই আদালত তিন তালাক নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার কথা বলেন। ভারত সরকার ও আইন কমিশনকে তিন তালাক প্রথা নিয়ে সব পক্ষের মতামত সংগ্রহ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপরে ব্যাপকভাবে জনমত সংগ্রহ করে আইন কমিশন। আলোচনা চলে নানা মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে। তিন তালাকের পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধরনের মতামতই প্রচুর সংখ্যায় জমা পড়ে। গত ১২ মে থেকে ১৮ মে এ মামলার শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

আরো সংবাদ