আজ - শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি, (গ্রীষ্মকাল), সময় - দুপুর ২:৪৫

প্রীতি ম্যাচে ইকুয়েডরকে হারিয়েছেন ১-০ গোলে আর্জেন্টিনা: এসময় খেলায় চোখে পড়ল যে ৫ বিষয়

প্রায় দশ মাস পর মাঠে নামল আর্জেন্টিনা। সেই যে গত নভেম্বরে উরুগুয়ের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন মেসিরা, এরপর প্রথম নামলেন আজ সকালে। তাও আবার প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ সামলে জাতীয় দলের হয়ে হয়ে এই প্রথম মাঠে নামা মেসিরা ইকুয়েডরকে হারিয়েছেন ১-০ গোলে। গোলটাও এসেছে পেনাল্টি থেকে। ম্যাচের ১৩ মিনিটে উইঙ্গার লুকাস ওকাম্পোসকে ডি-বক্সের মধ্যে ফেলে দেওয়ার মাশুল হিসেবে পেনাল্টি হজম করে ইকুয়েডর। সেখান থেকে গোল করতে একটুও সমস্যা হয়নি মেসির।

পূর্ণ তিন পয়েন্ট নিয়ে আর্জেন্টিনা মাঠ ছাড়লেও, দল হিসেবে আর্জেন্টিনা খেলেছে কেমন? পাঁচটা মূল বিষয় নজরে পড়েছে এ খেলায়। আসুন দেখে নেওয়া যাক!

ছক নিয়ে কোচের দ্বিধা

ম্যাচে আর্জেন্টিনা কাগজে কলমে খেলতে নেমেছিল ৪-৩-৩ ছকে। নিচে গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানির ওপরে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে লুকাস মার্তিনেজ কার্তা ও নিকোলাস ওতামেন্দির জুটি, দুপাশে দুই ফুলব্যাক নিকোলাস তালিয়াফিকো (বাম) ও গঞ্জালো মন্তিয়েল (ডান)। মাঝমাঠে পারেদেসের দুপাশে রদ্রিগো দি পল ও মার্কোস আকুনিয়া। ওপরে লওতারো মার্তিনেজের দুপাশে লিওনেল মেসি (ডান) ও লুকাস ওকাম্পোস (বাম)।

চমকের ব্যাপার হলো, মেসিকে ডানদিকে খেলানোর জন্য কোচ লিওনেল স্কালোনি ওকাম্পোসকে বাঁয়ে খেলিয়েছেন, যিনি ক্লাব ক্যারিয়ারে সেভিয়ার হয়ে এই মৌসুমে ডানে খেলছেন নিয়মিত। কাগজে-কলমে ওকাম্পোসকে বাঁয়ে রাখা হলেও, তিনি মোটামুটি ডান দিকেই থেকেছেন। কাগজে-কলমে মেসি ডানে খেলছেন বলা হলেও, যথারীতি ‘ফ্রি রোল’ দেওয়া হয়েছিল আলবিসেলেস্তি অধিনায়ককে। ডানে মেসির সঙ্গে ওকাম্পোসের রসায়ন চোখে পড়েছে, তবে দুজনই যেহেতু ডানে যেতে আগ্রহী ছিলেন, সে হিসেবে বাঁ দিকটা একদম ধারহীন ছিল আর্জেন্টিনার। ৪-৩-৩ ছকের তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে বাঁ দিকে থাকা মার্কাস আকুনিয়া যথেষ্ট পরিশ্রমী খেলোয়াড়, তবে সৃষ্টিশীল নন। বাঁ দিকে সৃষ্টিশীলতার অভাব ছিল তাই চোখে পড়ার মতো। ইকুয়েডরের মতো দলের বিপক্ষে একটু আক্রমণাত্মক চিন্তা করে বাঁ দিকে কেন আকুনিয়ার জায়গায় আতালান্তার ফর্মে থাকা লেফট উইঙ্গার আলেহান্দ্রো গোমেজকে খেলানো হলো না, আদর্শ ৪-৩-৩ ছকের মতোই কেন খেলানো হলো না, প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক তাই। ইকুয়েডর প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলনামূলক সহজই ছিল। গত বছর তাদেরই ৬-১ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা। তাই সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় বেশি না খেলালে দলের খেলা যে নির্বিষ হয়ে যায়, এটা হয়তো স্কালোনি বুঝেছেন আজকে আবারও।

মূল স্ট্রাইকার লওতারো মার্তিনেজের পেছনেই নিজের ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা করেছেন মেসি, আক্রমণ গড়ার চেষ্টা করেছেন, আদর্শ সহকারী স্ট্রাইকারের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন। ফলে ছকটা ৪-৩-৩ থেকে বদলে অনেকটা ৪-৪-১-১ হয়ে গেছে সময়-সময়। সবার ওপরে মূল স্ট্রাইকার লওতারো, নিচে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে মেসি, মাঝমাঠে দি পল ও পারেদেসের জুটি। দুপাশে আকুনিয়া আর ওকাম্পোস।

ঝামেলার ব্যাপার হলো, নিজের ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে লওতারো মার্তিনেজও অনেকটা দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলেন। তখন সামনে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে থাকেন বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। লুকাকুর জন্য নিয়মিত রক্ষণভাগে নিজের গতি ও কারিকুরি দিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের তটস্থ রাখেন মার্তিনেজ, ফলে গোল করার জায়গা পেয়ে যান অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী লুকাকু।

ম্যাচে মার্তিনেজকে যেন দেওয়া হলো ‘লুকাকু’র ভূমিকা। অধিনায়ককে রাইট উইঙ্গার বলা হলেও মেসি যেহেতু অনেকটা দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলেছেন, তাই ওপরে অনেক সময়ে একক স্ট্রাইকার হিসেবে কাজ করতে হয়েছে মার্তিনেজকে। তাও আর্জেন্টিনা হয়তো সুবিধা করতে পারত, যদি মাঝমাঠ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেতেন মার্তিনেজ।

মাঝমাঠে পারেদেসের সঠিক সঙ্গী নির্বাচন

মাঝমাঠ থেকে মার্তিনেজ তেমন সহায়তা পাননি, আগেই বলা হয়েছে। মিডফিল্ডার হিসেবে যে তিনজনকে নির্বাচন করা হয়েছে, সেই পারেদেস-দি পল-আকুনিয়ার মধ্যকার রসায়ন কতটুকু কার্যকরী, এ ম্যাচের পর প্রশ্ন উঠেছে আবারও। পারেদেসকে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলান হলেও তিনি খেলা গড়ে দিতে পছন্দ করেন, পেছন থেকে নিখুঁত পাস পাঠাতে পছন্দ করেন সামনে।

সে তুলনায় প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণ ভেঙে দেওয়া, ট্যাকল করা বা বল কেড়ে নেওয়া— ওসবে আগ্রহ নেই তাঁর। ফলে পারেদেসের ক্লাব পিএসজি যখনই তাঁকে মূল একাদশে খেলায়, সঙ্গে একটা আদর্শ ট্যাকলপ্রিয় বা বল কেড়ে নেওয়ায় সিদ্ধহস্ত রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার খেলিয়ে থাকে— মার্কিনিওসের মতো। এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে লাইপজিগের বিপক্ষে যা হয়েছিল। মার্কো ভেরাত্তির অনুপস্থিতিতে মার্কিনিওস পারেদেসের জন্য সমানে ট্যাকল করে গেছেন, বল কেড়েছেন। পারেদেস পেছন থেকে খেলা গড়ে দেওয়ার কাজটা করেছেন নিশ্চিন্তে। সে ম্যাচে পারেদেস খেলেছিলেন দুর্দান্ত।

আজ সকালে পাশে মার্কিনিওসের মতো কোনো রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ছিল না পারেদেসের। রদ্রিগো দি পল ও আকুনিয়ার মতো দুজন পরিশ্রমী খেলোয়াড় ছলেন ঠিকই, কিন্তু কোনোভাবেই আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার তাঁরা নন। ফলে প্রায় সময়েই পারেদেসকে ট্যাকল করার কাজটাও করতে হয়েছে। এবং যে কাজটা করতে গিয়েই হলুদ কার্ড খেয়েছেন। দি পল কিংবা আকুনিয়ার জায়গায় গিদো রদ্রিগেজের মতো একজন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার থাকলে পারেদেস আরও ভালো খেলতে পারতেন কি না, সেটা খোরাক হতে পারে স্কালোনির জন্য।

কারণ পারেদেসের মতো সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার ভালো না খেললে শুধু মার্তিনেজই নন, সমস্যা হয় মেসিরও। ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মেসি সেই যে গোল করেছিলেন, এরপর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে পেনাল্টি ছাড়া মেসির গোল নেই কোনো।

 

রক্ষণভাগে সঠিক রসায়নের অভাব

রক্ষণভাগে এখনো নিকোলাস ওতামেন্দির মতো ‘বুড়ো’রা খেলেন, এটা আর্জেন্টিনার জন্যই নেতিবাচক দিক। দুই সেন্টারব্যাকের মধ্যে ডানদিকে খেলা লুকাস মার্তিনেজ কার্তা দুর্দান্ত খেলেছেন। ওদিকে মার্তিনেজের রক্ষণ সঙ্গী হিসেবে ওতামেন্দির জায়গায় নতুন কাউকে নিয়মিত সুযোগ দেওয়া উচিত কি না, ভাবার সময় এসেছে আর্জেন্টিনার। দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের মধ্যে ডানদিকে মার্তিনেজ খেললে বাঁ দিকে এমন একজনের খেলা উচিত যিনি বাঁ পায়ে খেলতে স্বচ্ছন্দ। সে হিসেবে ফাকুন্দো মেদিনা বা অপেক্ষাকৃতভাবে অভিজ্ঞ ওয়াল্টার কানেমান হতে পারেন আদর্শ সমাধান।

আক্রমণাত্মক রাইটব্যাকের অভাব

রাইটব্যাক গঞ্জালো মন্তিয়েল বেশ সাবধানী খেলেছেন। গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানি কিংবা কিংবা রক্ষণ-সঙ্গী মার্তিনেজ কার্তার সঙ্গে বোঝাপড়াটা ভালোই ছিল তাঁর। কিন্তু আক্রমণে উঠতে গিয়েই গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন বারবার। ভুল পাস দিয়েছেন অনেক, সামনে গিয়ে আক্রমণ গড়তে গিয়ে ভজকট পাকিয়ে ফেলেছেন। এটা মনে রাখা জরুরি, মেসি যেহেতু ডানদিকে খেলেন, সেহেতু তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো হয় এমন একজনের খেলা উচিত রাইটব্যাকে, যিনি সমানতালে আক্রমণ ও রক্ষণ করতে পারেন। সে কাজে মন্তিয়েল কতটুকু যোগ্য, নাকি মন্তিয়েলের জায়গায় হুয়ান ফয়থ কিংবা রেনজো সারাভিয়াকে খেলান উচিত, সেটা হয়তো সামনে ভেবে দেখতে হবে স্কালোনিকে।

ঘরোয়া খেলোয়াড়দের প্রতি অতিনির্ভরশীলতা

জাতীয় দলে আর্জেন্টিনার বড় দুই ক্লাব বোকা জুনিয়র্স আর রিভার প্লেটের খেলোয়াড় রাখাই লাগবে, এক অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে যেন। গোলরক্ষক সহ গতকাল রক্ষণভাগে খেলা পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই ছিলেন রিভার প্লেটের খেলোয়াড় (মার্তিনেজ কার্তা, মন্তিয়েল ও আরমানি)। শেষ দিকে আকুনিয়ার জায়গায় যে সালভিওকে খেলানো হয়েছে তিনি এখন বোকায় খেলেন।

চোখ এখন বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের দিকে। লা পাজের প্রতিকূল পরিবেশে স্কালোনি কি দলের সঠিক রসায়ন খুঁজে বের করতে পারবেন?

আরো সংবাদ