বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক পুরোনো।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় এক নম্বরে বদির নাম।
বদির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী পাইনি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কেউ প্রমাণ করতে পারলে পদত্যাগ করব: বদি
মাদকবিরোধী অভিযানের আগে পাঁচটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সমন্বয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের একটি তালিকা তৈরি করে সরকার। সেই তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে কক্সবাজার-৪ আসনের (উখিয়া-টেকনাফ) সাংসদ আবদুর রহমান বদির নাম। তবে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ অনেক পুরোনো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় এক নম্বরে আছে বদির নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা টেকনাফের শীর্ষ মানব পাচারকারীর তালিকাতেও তাঁর নাম ছিল। তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারি দলের সাংসদ বলে যদি বদির নাম বাদ যায়, তাহলে পুরো অভিযানই প্রশ্নের মুখে পড়বে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বদির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী আমরা পাইনি। নাম থাকলে তো চলবে না। প্রমাণ তো করতে হবে তিনি অপরাধী।’
অভিযোগ থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তো তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল, এখন কেন বলছেন অভিযোগ নেই? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণ পায়নি বলে দুদক তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল। তাহলে আমরা কী করে ব্যবস্থা নেব?’
তাহলে প্রতিদিন অভিযান হচ্ছে, লোকজন ‘ক্রসফায়ার’ হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে? মন্ত্রী বলেন, ‘“ক্রসফায়ার” কোথাও হচ্ছে না। যা হচ্ছে সেটা বন্দুকযুদ্ধ। খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করতে গেলে তাঁরা পুলিশের ওপর গুলি ছুড়ছেন। তারপরও আমরা তিন হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করেছি।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, দেশে মাদকের ব্যবহার ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাওয়ার পর সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাঁচ সংস্থার তৈরি করা তালিকার ভিত্তিতে একটি অভিন্ন তালিকা তৈরি করা হয়। এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, অভিন্ন তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত মঙ্গলবারও গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের করা প্রতিবেদনে যার নাম আছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে এই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার কথা ঘোষণা করা হলেও পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
৩ মে র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি নির্মূলের মতো এবার মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন র্যাবকে। এরপর সারা দেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নামে এই এলিট বাহিনী। র্যাবের অভিযান শুরুর পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশজুড়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গতকাল বিবিসিকে বলেছেন, ‘এই ধরনের গডফাদাররা অনেক পেছনের স্তরের। এটা ১০-১২ স্তর পেছনে হতে পারে। ওই পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে তাঁদের বিষয়ে এখনই কোনো কিছু প্রকাশ করা যাবে না। প্রকাশ করা হলে তো তাঁরা টের পেয়ে যাবেন এবং সটকে পড়বেন। কাজেই আমি মনে করি, র্যাবসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তৎপর রয়েছেন। তাঁরা মূল হোতাদের আটক করতে সক্ষম হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত হোতারা যে দেশীয় অপরাধী, তা বলা যাবে না। এরা সম্ভবত আন্তর্জাতিক অপরাধী। প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, কেউ ছাড় পাবে না। যদি আমাদের দলের লোকও হয়, তারপরও তাদের ছাড়া হবে না।’
এদিকে দেশে মাদক ইয়াবার গডফাদার ও ব্যবসায়ীর তালিকায় টানা ১০ বছর ধরে বদির নাম ছিল। কিন্তু গত মার্চ মাসে একটি সংস্থার তালিকা থেকে সেই নাম বাদ দেওয়া হয়। তবে সেই তালিকায় বদির পাঁচ ভাই, এক ফুপাতো ভাই, দুই বেয়াই ও এক ভাগনের নাম আছে। তালিকায় সব মিলিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে কক্সবাজারের ৮ উপজেলার ১ হাজার ১৫১ জনের নাম আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত মে মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর শীর্ষ ১৪১ ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকের তালিকা দুদকে জমা দেয়। এই তালিকায় আবদুর রহমান বদির নাম ছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংসদ আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁর ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। সরকারদলীয় সাংসদ হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনুসারী নিয়ে তিনি ইচ্ছামাফিক ইয়াবা ব্যবসা থেকে আয় করেন। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও তাঁর অনিচ্ছার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা করার সাহস রাখেন না।
জানতে চাইলে সাংসদ আবদুর রহমান বদি গতকাল বুধবার টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাহলে আমি পদত্যাগ করব। বরং আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ করি মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে কী করা যায়।’
তাহলে জড়িত না থাকলেও বারবার আপনার নাম আসে কেন, জানতে চাইলে বদি বলেন, ‘কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতে জামায়াতে ইসলামীর আধিপত্য বেশি। একটি আসন আমি ধরে রেখেছি। ওই আসনে আমি যেন নির্বাচন করতে না পারি, সে জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এই আসনে জয় এনে আমি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছি। এখন সরকারের বদনাম করতেই এসব বলা হচ্ছে।’
এর আগে জাতীয় সংসদ অধিবেশনের বক্তব্যেও বদি চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, কোনোভাবে তিনি ইয়াবা ব্যবসা বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রমাণ করতে পারলে তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন।
সরকারি সূত্র জানায়, রাজনীতিক হিসেবে তিনি দলের ভেতরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও এখন তাঁর গুণকীর্তন করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে এক সভায় বলেন, কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফে) আসনে আলোচিত সাংসদ বদির কোনো বিকল্প নেই।
তবে উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, কক্সবাজার বা টেকনাফে সাংসদ বদি তাঁর ভাই, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার ৩০ থেকে ৩২ জনকে নিয়ে এই ব্যবসা করছেন। কিন্তু তিনি যত দিন ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ থাকবেন, তত দিন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কেননা এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘সরকারের তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যদি সাংসদ বদির নাম থাকে, আর সে যদি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে, তবে তো তার উচিত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা। অন্যদিকে সরকার তো বদির বিষয়ে প্রমাণ চাইছে, তাহলে প্রতিদিন বন্ধুকযুদ্ধে যাদের মারা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কী প্রমাণ ছিল? আর প্রমাণ পাওয়ার প্রক্রিয়া কী, সেটাও সরকারের পরিষ্কার করা উচিত।’
সূত্র: প্রথম আলো ও বিবিসি।