আজ - সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - সকাল ৯:৩২

বৃহস্পতিবারের মধ্যে দাবি না মানলে হাজারো পানিবন্দী মানুষ পথে নামবে(ভিডিও)

সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা। যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভবদহ অঞ্চলের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। তাদের অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ড। প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘পানি সরাও, মানুষ বাঁচাও, ভবদহের কান্না কি আপনারা শুনতে পান না?’, সেচ প্রকল্পে সমাধান হবে না, টিআরএম চালু কর, মাঘী পূর্ণিমার আগে বিল কপালিয়ায় টিআরএমের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কর, এলাকার সকল নদী ও খাল পুনরুদ্ধার কর, হরি, শ্রী ও মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ দাও, আমডাঙ্গা খাল সংস্কার কর ইত্যাদি। আগামী তিন দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের মধ্যে দাবি মানা না হলে হাজারো পানিবন্ধী মানুষ পথে এসে দাঁড়াবে।

পানি সরাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন গতকাল জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ের সামনে শত শত কৃষক ও পানিবন্দী ভুক্তোভোগীরা এভাবেই হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রায় সব বয়সের মানুষের উপস্থিতি ছিল এই আন্দোলনে। স্লোগানে ঠাই পেয়েছে পানি সরাও মানুষ বাঁচাও, ত্রাণ নয় পরিত্রাণ চাই, পানি সরাও কৃষক বাঁচাও। স্লোগানে মুখরিত লাল প্রাচীরের চার পাশ। চলতি পথে উৎসুক জনতাও একবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন ঘটনা জানার জন্য।

এমনি একজন পথচারী বেজপাড়ার হাদিউজ্জামান অনেক সময় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ভবদহ বাসীদের দুর্দশার চিত্র। কথায় কথায় বললেন, এসব মানুষের জন্য খুব কষ্ট হয়। বছরের পর এভাবে পানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা কি আদৌ সম্ভব। কেন যে সরকার তাদের দাবি মেনে নিচ্ছে না।

তিনি বলেন, ইচ্ছে করছে তাদের মাঝে বসে আমিও চিৎকার করে বলি পানি সরাও মানুষ বাঁচাও, পানি সরাও কৃষক বাঁচাও।

৪১ বছর ধরে এভাবেই আন্দোলন করে চলেছেন ছিয়ানব্বই গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। ছয় দফা দাবিতে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির ডাকে রোববার দুপুর থেকে ডিসি কার্যালয়ের সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেছেন জলাবদ্ধ ভবদহ অঞ্চলের মানুষ। গতকাল সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মসূচি শুরু হয় সকাল ১০টার দিকে, যা চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।

ওই ছয় দফা দাবি হলো : প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ সেচ প্রকল্প বাতিল, ক্রাশ প্রোগ্রামে মাঘী পূর্ণিমার আগেই বিল কপালিয়া টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট বা জোয়ারাধার) চালু, ভবদহ স্লুইসগেটের ভাটিতে ৫৬টি এক্সকাভেটর দিয়ে পাইলট চ্যানেল খনন ও ২১, ৯, ৬ ভেন্টের গেটগুলো ওঠানামার ব্যবস্থা করা, জনপদের ফসল, বাড়িঘরসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ, কৃষিঋণ মওকুফ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আমডাঙ্গা খাল সংস্কারকাজে প্রি-ওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্ক জনসমক্ষে টাঙিয়ে দেয়া ও কাজের স্বচ্ছতা নিরূপণে আন্দোলনকারী সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তদারকি কমিটি গঠন করা এবং সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নদী হত্যা, জনপদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, ফসল, বসতবাড়ি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ভবদহ নিয়ে অতীতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে যে প্রকল্পগুলি এ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে তা ভবদহবাসীর কোন কাজে আসেনি। আমরা আর কোন ষড়যন্ত্র সহ্য করবো না। তাই এবার ৬ দফা দাবি নিয়ে ভবদহবাসী রাস্তায় নেমেছে।

তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগামী বৃহস্পতিবারের ভেতর যদি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি মেনে না নেয়া হয় তাহলে আরও কঠিন কর্মসূচি দেয়া হবে। তখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে।
এ সময় সংহতি প্রকাশ করে অনিল বিশ্বাস বলেন, কয়েকজন মানুষের দুর্নীতির জন্য কয়েক লাখ মানুষ আজ পানিবন্দী। এই দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ আজ রাস্তায় নেমেছে। সরকারের উচিত ভবদহবাসীর দাবি মেনে নিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আন্দোলনকারী আশরাফ আলী বলেন, আমাদের বর্তমান অবস্থা এমন, মরে গেলেও কবর দেয়ার জায়গাটুকু নেই। লাশ কাঁধে করে কয়েক গ্রাম হেটে যেয়ে কবর দিতে হচ্ছে। বাড়ির উঠানে পানি। রাস্তা থেকে ঘরের দরজা অবধি যেতে বাশের সাঁকো তৈরি করতে হয়েছে।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতাদের দাবি, ভবদহ অঞ্চলকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তাবিত ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প বাতিল করতে হবে। তারা আরও দাবি করছেন বিএডিসি ও পাউবো যৌথ উদ্যোগে সেচ র্কাযক্রম শুরু করলেও ভবদহ স্লুইস গেট দিয়ে সেচ পাম্পে পানি নিষ্কাশন র্কাযক্রম সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তারওপর স্লুইস গেটের নিচ দিয়ে লিকেজ হওয়ায় শুধুই পাম্পে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডতো দেশের বাইরের কোন সংস্থা না। আমরা সরকারি সংস্থা আমরা মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কাজ করি। সরকার ও মন্ত্রণালয় নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করি। এর বাইরে আমাদের কোন কিছু করার সুযোগ নেই।

স্লুইস গেট সম্পর্কে তিনি বলেন, পাম্প করে দিলে পানি যাচ্ছে কিন্তু এখানে আমাদের যে ক্যাপাসিটির পাম্প দরকার সে পরিমাণ ক্যাপাসিটির পাম্প বসানো যায়নি। যার কারণে কোন কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে বড় পাম্প দেয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। আর টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য সময় লাগবে, তবে প্রক্রিয়া চলছে।
কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালী, যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আবদুল হামিদ, সদস্য সচিব চৈতন্য পাল, শিবপদ বিশ্বাস, কার্ত্তিক বকসি, ভগিরথ হালদার, দীপঙ্কর বকশি, কমল মধু, যশোর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান প্রমুখ। এ ছাড়া সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অনিল বিশ্বাস, বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম, যশোর শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান প্রমুখ।

দৈনিক কল্যাণ

আরো সংবাদ