যশোরের মণিরামপুরে ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত ২৯২টি ঘরের মধ্যে অন্তত ৫৬টি ঘর খালি পড়ে আছে মাসের পর মাস। এক বছর আগে ঘরগুলো ভূমিহীনদের বুঝে দেয়া হলেও এসব ঘরে থাকে না কেউ। ঘর দখলে রেখে তালা মেরে তারা থাকছে নিজের বা পৌত্রিক ভিটায়। এছাড়া এমন আরো ৩০-৪০ টি ঘর আছে যেখানে নিয়মিত থাকছে না কেউ। ঘর দখলে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে এ ঘরে থাকলেও বেশির ভাগ সময় তারা থাকেন আগের ঠিকানায়।
প্রকৃত ভূমিহীন নির্বাচন করে ঘর বরাদ্দ না দেয়ায় এমনটি ঘটছে বলে জানা গেছে। ছাদের বাড়ির মালিক, সম্পদশালীর ছেলে, অবিবাহিত কিশোর, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্স্যের বাবা বা সন্তান এমনকি অন্য উপজেলার বাসিন্দারাও পেয়েছেন সরকারি ঘর।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আশপাশের বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রকৃত ভূমিহীনরা ঘর পায়নি। যারা ঘর পেয়েছেন তাদের অধিকাংশের ফসলি জমি বা বসত ভিটা আছে। সঠিক যাচাইবাছাই না করে অর্থের বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দেয়ায় বেশিরভাগ ঘর খালি পড়ে আছে।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের জন্য গত বছর মণিরামপুরে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯২ টি ঘর নির্মিত হয়েছে। সংযুক্ত টয়লেট, রান্নাঘর ও বারান্দাসহ দুই কক্ষের রঙিন টিনের চার চালার প্রতিটি ঘরে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
তারমধ্যে উপজেলার মাছনায় ৬৬টি, হাজরাইলে ৫৯টি, মধুপুরে ৩৭টি, শিরালীতে ৩৭টি ও মশ্মিমনগরে ৩৩ টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলোর মধ্যে মাছনায় ১০টি, হাজরাইলে ১৬টি, শিরালীতে ১১টি, মধুপুরে দুই পল্লীতে ১২টি ও ৬টি মোট ১৮টি এবং মশ্মিমনগরে ১ টি ঘর তালাবদ্ধ খালি পড়ে আছে। এছাড়া এমন আরো ৩০-৪০ টি ঘর আছে যেখানে নিয়মিত থাকছেন না কেউ।
এদিকে পুরনো ঘর ফাঁকা পড়ে থাকলেও মণিরামপুরের মশ্মিমনগর, শ্যামকুড় ও খেদাপাড়ার হেলাঞ্চি এলকায় ভূমিহীনদের জন্য নতুন করে আরো ১৫ টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। নতুন এসব ঘরে প্রতিটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
ঘর বিতরণে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে মধুপুরে। এখানে দুই ব্যক্তির দখলে রয়েছে ১২টি ঘর। এজাজুল ইসলাম মধু নামে ওই এলাকার এক মুদি ব্যবসায়ীর দৃষ্টিনন্দন ছাদের বাড়ি থাকতেও তিনি নিজের, দুই মেয়ে, বোন, ভাগ্নি ও ভাইঝির নামে ৬টি ঘর নিয়েছেন। মধুর দখলের ঘরগুলো শুরু থেকে তালাবদ্ধ খালি পড়ে আছে।
একই পল্লীতে স্ত্রীর নামে ঘর পেয়েছেন ওসমান হোসেন নামে ছাদের বাড়িওয়ালা। ওসমানের ঘরের পাশে ৫টি ঘর পেয়েছেন আলতাফ হোসেন। দুই স্ত্রী, দুই পুত্রবধূ এবং শ্যালিকার নামে তিনি ঘরগুলো নিয়েছেন। আলতাফের দুই ছেলে চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। শ্যালিকাও থাকেন ঢাকায়। ফলে আলতাফের দখলের ৩টি ঘর তালাবন্ধ পড়ে আছে।
আলতাফ হোসেন বলেন, মধুপুরে ২৪ শতক খাস জমি আমার দখলে ১৫ বছর। এখানে আমার দুটো টিনের ঘর ছিলো। ইউএনও এসে বলেছেন, ঘর ভেঙে দেন। আমি ঘর করে দেবো।
মধুপুর এলাকার সম্পদশালী আনোয়ার খাঁর দখলে ছিলো মাঠপাড়ার বড় প্লটের সরকারি একটি খাস জমি। জমি দখলে থাকার সুবাদে সেখানে নির্মিত ১৫টি ঘরের মধ্যে দুটি ঘর পেয়েছেন তার বড় ছেলে মোশারফ হোসেন এবং মোশারফের কিশোর ছেলে মনোয়ার হোসেন। হরিহরনগর ইউপির মহিলা মেম্বর মেহেরুননেছা ছেলে বরিউলের নামে একটা ঘর নিয়েছেন। এ তিনটিসহ ওই পল্লিতে মোট ৬টি ঘর তালাবদ্ধ পড়ে আছে।
মোশারফ হোসেন বলেন, মধুপুর মাঠপাড়ায় আমি ৩২ শতক জমি কিনেছিলাম। নিবন্ধন করতে যেয়ে দেখি জমিটি খাসের। ইউএনও জমি নিয়ে ঘর করেছেন। আমাকে দুটো ঘর দিয়েছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, হরিহরনগর ইউনিয়নের নায়েবসহ সংশ্লিষ্টরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। কাগজপত্র বা ব্যক্তির তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করে তারা এ কাজ করে সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছেন। এদিকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাছনা, হাজরাইল পল্লিতে ঘর নির্মাণের দায়িত্বে থাকা দুই শ্রমিক ঠিকাদারকে দুটো ঘর দেয়া হয়েছে। ভূমিহীনদের ঘরের নকশা বাদ দিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে ঘর দুটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের ঘর দুটো খালি পড়ে আছে। এ দুই ঠিকাদারের একজনের বাড়ি কেশবপুর উপজেলায়।
একাধিক ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাছনার ১০টি, হাজরাইলের ১৬টি, শিরালীর ৬টি, মধুপুরের ৬টি ও মশ্মিমনগরে ১ টি ঘর মোট ৩৯টি ঘরের বরাদ্দ বাতিলের জন্য তালিকা করা হয়েছে। এসব ঘর নতুন করে বরাদ্দ দেয়া হবে।
খানপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা বিষ্ণুপদ বলেন, মাছনায় ১০ টি ঘর ফাঁকা ছিলো। আমরা ৯টি ঘরে নতুন লোক উঠিয়ে দিয়েছি। এ ১০টি ঘরের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনদের নামে বরাদ্দের আবেদন করা হবে।
হরিহরনগর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, মধুপুরে মধুর দখলের ৩ টিসহ মোট ৬ টি ঘর বাতিলের আবেদন করা হয়েছে মোশারফের বিষয়ে তিনি বলেন, লোকটার দখলে জমিটা ছিলো। সেটি আমরা নিয়েছি। ঘর না দিলে অমানবিক হয়ে যায়।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, উপজেলায় ৩৫ টি ঘর নতুন করে পুনর্বাসনের জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা দ্রুত জেলা প্রশাসকের দফতরে পাঠানো হবে।