মোঃ মহিউদ্দিন সানি (যশোর প্রতিনিধি) ।। বর্তমান যুগে গেমিং অ্যাডিকশন, অনলাইন মোবাইল বা ভিডিও গেমে আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অন্যান্য নেশার মতো ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করা বা অধিক সময় ধরে অনলাইনে গেম খেলাও একটি আসক্তি। মানুষের মধ্যে এ ধরনের আসক্তিকে বলা হয় আচারণগত আসক্তি। কেবল স্মার্টফোনের সহায়তায় নতুন প্রজন্ম আজ আসক্ত হয়ে পড়েছে অনলাইন গেম নামের এক করুণ নেশায়। ঘরে–বাইরে, রাস্তা–ঘাটে অনেককে দেখা যায়, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে গেম খেলছে। মাদকাসক্তির মতোই অনলাইন গেম বর্তমান তরুণদের গ্রাস করে ফেলছে।
পিছিয়ে নেই যশোর সদর উপজেলাধীন রূপদিয়া অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। লকডাউনে সকলেই প্রায় বই থেকে দুরে। অনলাইন ক্লাসের ছুতোয় এ অঞ্চলের শতভাগ শিক্ষার্থী স্মার্টফোনের মালিক। এতে সংক্রামকের মত ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে তারা। রূপদিয়াতে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি অনার্সপড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তরুণেরাও অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন; যা এখন শুধু একটি নেশা নয়, মানসিক সমস্যায়ও পরিণত হয়েছে। একসময় তারা অবসর কাটাত বই পড়ে, মাঠে খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতি–সভ্যতার চর্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা এখন অনলাইনভিত্তিক গেমগুলোকে আপন করে নিচ্ছে।
রূপদিয়ার বাজার এলাকাসহ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় এ দৃশ্য নিত্যদিনের। রূপদিয়ার শিক্ষক ও অভিভাবকরা তাদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন। পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সি শিক্ষার্থীদের অনলাইন গেম খেলার দৃশ্য চোখের পড়ার মতো। শিক্ষক ও অভিভাবকদের অভিযোগ, সারাদিন এমনকি রাত জেগে ইন্টারনেটে খেলছে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো নেশা ধরা গেম। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে স্কুল, কলেজ পড়ুয়ারা মোবাইলে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, যা মাদকের চেয়ে ভয়ংকর। অধিকাংশ অঞ্চলে কিশোররা ইন্টারনেটে গেম নিয়ে পড়ে থাকছে। যাদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদেরকে গেম আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনার কতগুলি উপায়ও আছে। রূপদিয়ার শুশীলরা বলছেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এভাবে মুঠোফোন, ল্যাপটপ–কম্পিউটারে গেমের প্রতি আসক্তি একটি হুমকির কারণ। ইন্টারনেটের যুগে গেম–আসক্তির বিষয়টি অন্যান্য আসক্তির চেয়ে গুরুতর। আমাদের চারদিকে একটু নজর দিলে দেখা যায়, কেউ অনলাইনে গেমের প্রতি আসক্ত, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউ মুভি দেখায়, আবার কেউবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু ব্যয় করে ফেলছে। তারা বলছেন, ঐক্যবদ্ধতা এবং অভিভাবকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ছেলে-মেয়েদের শাসনে রাখতে হবে। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকে এসব গেম থেকে দুরে রাখতে হবে। শিঘ্রই বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে গেম আসক্ত হয়ে পড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সমন্বয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। তাদেরকে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। খেলার মাঠে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
শুশীলরা বলছেন, ১৮ বছরের নিচে সকল শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে মোবাইল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজন আছে। এজন্য সন্ধ্যায় বা সকালে সময় নির্ধারণ করে দিতে এ অঞ্চলের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিকে একত্রিত হতে হবে।
মূলতঃ করোনার প্রভাবে রূপদিয়া অঞ্চলে বেড়েছে গেমিং অ্যাডিকশন। দিনে দিনে তা বাড়ছে। এতে অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। অনলাইনে ক্লাস করার অজুহাতে মোবাইল হাতে পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কোন ভাবেই একবার ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে তাকে আর ফেরাতে পারছেন না অভিভাবকরা।
তন্ময় (ছদ্মনাম) সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। সম্প্রতি স্কুল থেকে দেওয়া এসাইনমেন্টের উত্তর খুজতে ও স্কুলের ফেসবুক পেইজে আপলোড হওয়া শ্রেণীপাঠে যোগ দিতে সে বাবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বাবার কাছে নিজের জন্য একটি স্মার্টফোন কিনে দিতে আবদার করে। বাবা অনেকটা বাধ্য হয়ে তার ১৩ বছরের ছেলেটিকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেন। তন্ময় নতুন ফোন পেয়ে সবসময় নিজেকে ঘরের কোনায় লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই সে ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে শুরু করে। এখন তন্ময়ের চোখের কোনায় কালো দাগ পড়েছে। খাওয়া দাওয়া আর বইপড়ার প্রতি এখন তার কোন আগ্রহই নেই।
অথচ, তন্ময়ের বাবার স্বপ্ন ছিলো তন্ময় বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিছুদিন আগেও যার চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ছিলো, যে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ভাবতো সেই ছেলেটি আজ অনলাইন গেমে আসক্ত। তন্ময় দিনে দিনে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এভাবেই একটি উজ্বল ভবিষ্যৎ আলো হারিয়ে ফেলছে।
এ বিষয়ে সচেতন মহলের একজন অভিভাবকের বক্তব্য অন্যরকম। তিনি বলছেন, এ বয়সে অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলার বিষয়টি সর্বদা চিন্তাচেতনা ও আচারণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা সামাজিক দক্ষতাকে কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে মা–বাবার ভূমিকাও প্রভাব ফেলে। দেখা যায়, মা–বাবা তাঁদের ব্যস্ত সময়ে সন্তানের সঠিক খেয়াল রাখতে পারেন না। সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানের হাতে তুলে দেন মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার। মা–বাবা তাঁদের সন্তানের হাতে এ ধরনের ডিভাইস তুলে দিয়ে নিজেরা স্বস্তি অনুভব করেন। অথচ খোঁজখবর রাখেন না, তাঁর সন্তান এগুলোর সঠিক ব্যবহার করছে কি না। এদিকে সন্তানেরা স্বাধীনতা পেয়ে যায় ইন্টারনেট দুনিয়ায়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের খেয়ালখুশিমতো দিনরাত ইন্টারনেটের বিভিন্ন গেমিং সাইট বা অনলাইন গেমে মেতে ওঠে, যা একসময় আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। ঘরে আবদ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলায় মগ্ন হয়ে থাকে। খাওয়াদাওয়ার কথা ভুলে সব চিন্তাচেতনা গেমের প্রতি দিয়ে দেয়। সব আনন্দ যেন অনলাইন গেমজুড়ে। এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডেটা অন করে গেম খেলা শুরু করে চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। গেমের প্রতি আসক্তির ফলে পড়াশোনা বা স্বাস্থের প্রতি কোনো খেয়াল থাকে না। মেজাজ থাকে সর্বদা খিটখিটে। পরিবারের কেউ ডাকলে সারা না দিয়ে রাগারাগির পর্যায়েও চলে যায়। এ ধরনের আচারণগত সমস্যাগুলো সামাজিক জীবন ও তরুণ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব দায় অভিভাবককেই নিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১) ‘গেমিং অ্যাডিকশন’কে এক মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুনে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগনির্ণয় গাইড বুকে এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
শিঘ্রই উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে হলে অভিভাবকদের পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহল, শিক্ষক-শিক্ষিকা, জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সকল শ্রেনি-পেশার ভুক্তভোগী জনগন।