আজ - বৃহস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ৭:১৭

সাংবাদিক: মগের মুল্লুকের ‘ওয়াচডগ’?

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বাংলাদেশ স্বর্গ বলে বিবেচিত হতে পারে। আমার অন্তত তাই মনে হয়। যেই দেশে যত অনাচার সেই দেশেই পরোপকারী, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাকারী মানুষের প্রয়োজনীয়তা তত বেশি।

বাংলাদেশে তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ তলানিতে যেতে থাকলেও অসৎ ও দুর্নীতিবাজ মানুষের বিপুল সম্ভার আরো দুই প্রজন্মেও ফুরোবে না বলে লোকাল বাসে, চা দোকানে আলাপে-আড্ডায় শোনা যায়।

এ দেশে সোনার মেডেল থেকে শুরু করে খনিতে লুক্কায়িত কয়লা এবং চাল-ডাল-তেল-নুন-মাছ-মাংস থেকে শুরু করে ওষুধ-দুধ-স্নো-পাউডার হেন দ্রব্য নেই যাতে ভেজাল ও দুই নম্বরী নেই। যে দেশে লাভের লোভে বণিক-রাজনীতিক-ডাক্তার-আমলা-কামলা এক গোত্র আরেক গোত্রকে ঠকানোর নিমিত্তে ক্রমাগতভাবে নব-নব কায়দা বাৎলায়, সেই দেশই নিশ্চয়ই দুনিয়ার বুকে মগের মুল্লুকের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

তাই, এই মগের মুল্লুকেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি দরকার।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকের তদন্তের পর পৃথিবীর নানান দেশে চুরি-চামারি-ফাঁকি-ঝুঁকি-পুকুর-নদী-সাগর চুরির তথ্য প্রকাশ হয়েছে। সত্য প্রকাশের জের হিসেবে দোষী ও দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবনে ও আপিসে লাল বাতি জ্বলে গেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জেরেই সত্তরের দশকে এমনকি গদি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জের হিসেবে ২০১৮ সালের শেষের দিকে ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটে গেছে পোল্যান্ডে। একজন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক কসাইয়ের ছদ্মবেশ ধরে এক কসাইখানায় কাজ নেন। নীতি বিসর্জন দিয়ে মরা ও অসুস্থ গরুগুলোকে কীভাবে কারসাজি করে ভালো মাংস হিসেবে বাজারে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটির প্রমাণ স্বরূপ ছবি ও ভিডিও জোগাড় করতে থাকেন তিনি। এভাবে মোট ১২০ ঘন্টার ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করেন সাংবাদিক পেট্রিক সেপেনিয়াক।

তার এই প্রতিবেদনের জেরে পোলিশ মাংস ব্যবসায় ধস নামে। ইউরোপে মুখ থুবড়ে পড়ে পোল্যান্ডের মাংস রপ্তানি বাণিজ্য। ফলে, চলতি ২০১৯ সালেই পোলিশ গো-মাংস শিল্প অন্তত ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসানের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই প্রতিবেদনের পর কসাইখানায় নজরদারীতে শিথিলতার দায়ে পশু পরীক্ষণ দফতরের ডেপুটি প্রধান চাকুরীচ্যুত হন।

এরচেয়েও আরো গভীর প্রভাব সৃষ্টিকারী ঘটনা রয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে।

খ্রিস্ট ধর্ম যাজকেরা যে বছরের পর বছর ধরে শিশু-কিশোরদেরকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন করে যাচ্ছিলেন সেটি ছিল মার্কিন খ্রিস্টান সমাজে অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু এই ধর্ম-যাজকদের কুকর্মের কোনো তথ্য প্রমাণ হাতে পাওয়া যাচ্ছিলো না। কারণ ধর্ম-যাজকদের ইমেজ বা ভাবমূর্তি রক্ষার নামে তাদেরকে লোকচক্ষুর অন্তরালে সুরক্ষা চাদরে ঢেকে রেখেছিল সমাজের নানান প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মধ্যে এমনকি আদালতের সংশ্লিষ্টতাও ছিল। কিন্তু ধর্ম যাজকদের বিরুদ্ধে আঠার মতন লেগে থাকে বোস্টন গ্লোব পত্রিকার এক দল অবিশ্রান্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিক। দিন রাত কয়েকজন সাংবাদিক তদন্ত করে তুলে আনে পাদ্রীদের হাতে নিপীড়িত হওয়া শত-শত যৌন কেলেঙ্কারির কাহিনী ও তথ্য-প্রমাণ। খ্রিষ্টান সমাজের মনোজগতে এর প্রভাব ছিল গভীর ও তীব্র।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। মামুলী চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা কেঁচো খুঁড়তে অজগর পেয়ে যান। ধারাবাহিক প্রতিবেদনে একের পর এক উঠে আসতে থাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পুন:নির্বাচন নিয়ে চক্রান্তের বিস্তারিত বিবরণ। সেই চক্রান্তে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সবার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। চক্রান্ত ধরা পড়ার জের হিসেবে অবশেষে ১৯৭৪ সালের অগাস্ট মাসে গদি ছাড়তে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।

উন্নত বিশ্বের দেশে-দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা সমাজের অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে চিহ্নিত। সবাই ঘুমিয়ে গেলেও সাংবাদিকের কলম জেগে থাকে। তাই, বইয়ের ভাষায় সাংবাদিকতাকে বর্ণনা করা হয় সমাজের ‘ওয়াচডগ’ বা প্রহরী হিসেবে। বাড়িতে রাতের অন্ধকারে চোর এলে ঘুমের ঘোরে গৃহকর্তা তা টের পান না। কিন্তু টের পায় মনিবের পোষা কুকুর। গণমাধ্যমও সেরকম। জনস্বার্থেই সাংবাদিকের জেগে থাকা।

সাংবাদিকের রক্ষাকবচ হচ্ছে জনস্বার্থ। জনস্বার্থে সাংবাদিক ছদ্মবেশ ধরে হলেও তথ্য বের করে আনতে পারেন। সাংবাদিকের ছদ্মবেশ ধরার কথা এলেই মার্কিন সাংবাদিক নেলি ব্লাই-এর কথা মনে পড়ে। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন নারীদের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে অমানবিক আচরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সেটি প্রমাণের কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না। এমন অবস্থায় তরুণী সাংবাদিক নেলি ব্লাই মানসিক রোগী সেজে সেই উনিশ শতকের আশির দশকে দশদিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন। নিরেট পাগলের মতন তার অভিনয় দেখে এমনকি খোদ ডাক্তাররাও মিজ. ব্লাইকে পাগল বলে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন। এভাবে দশদিন তিনি ছিলেন সেই উন্মাদ নিরাময়াগারে। দশ দিন পর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে যে অসাধারণ প্রতিবেদনগুলো লিখেছিলেন নেলি ব্লাই তাতেই তিনি ভুবন বিখ্যাত হয়ে আছেন।

জনস্বার্থ সবার ওপর। জনস্বার্থের রক্ষাকবচের জোরেই সত্তর দশকে রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্ট। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় গোপন নথি পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিল দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।

বিভিন্ন সময়ে একটি কথা বন্ধু-বান্ধব-শিক্ষার্থী-পরিচিত পরিমণ্ডলে বলে থাকি। কথাটি হচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি, সর্বময় সামাজিক অনাচারের কালে আমাদের দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

অসৎ-দুর্নীতিবাজদের ডেরায়-ডেরায় সাহসী সাংবাদিকেরা হানা দিয়ে অনাচারের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে জনস্বার্থে জনসম্মুখে তা প্রকাশ করে দিতে পারেন। অসাধুতা ও অন্যায়ের তথ্য প্রকাশ হলে জনমনেও এর একটা ধাক্কা তৈরি হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো দুনিয়াকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধ নীতি থেকে সরে আসার জন্য সরকারের উপরে তখন প্রবল চাপ তৈরি করেছিল যুদ্ধ বিরোধী মার্কিন জনতা।

সাংবাদিকদের পাশাপাশি আইনজীবীরাও মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিতে পারেন অন্যায়কারীদের জন্য। তারা আগ বাড়িয়ে নিজে থেকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন। অন্যায়কারীর অর্থ ও ক্ষমতার হাত যত বড়ই হোক না কেন আইনের হাত যে তার চেয়ে বলিষ্ঠ সেই সত্য আইনজীবীরা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হলে দেশে অন্যায়কারীর ‘বুকের পাটা’ ছোটো হতে বাধ্য। সাংবাদিক ও আইনজীবীর যৌথ-প্রচেষ্টায় অনাচারের মাত্রা কমবে; দুর্বলও বুকে বল পাবে; নিপীড়িত ও অসহায় মানুষও পাবে আশার আলো।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা-ওয়াচডগ

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে মাকরেকিং জার্নালিজম বলে একটি ধারণা আছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতিগ্রস্ত বণিক ও খনি মালিকদের ফুলের মতন চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কাঁটা খুঁজে বের করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা সত্য-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় অঘোষিত এক জিহাদে নেমেছিলেন। সেই জিহাদই পরে মাকরেকিং জার্নালিজম বলে পরিচিত হয়।

দেশ গঠনের জন্য সকল পক্ষের অংশগ্রহণ জরুরি। কিন্তু যে ভূখণ্ডের সামাজিক পিরামিডের চূড়া থেকে তলানি পর্যন্ত, মানে আমলা থেকে কামলা সকলেই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সে ভূখণ্ডের আগাপাশতলা বদলানো দরকার। বদল কখনোই হাওয়ায় ভর করে আসে না। বদলের জন্য একদল মানুষকে প্রমিথিউসের মতন সাহসে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।

পৃথিবীব্যাপী যুগে-যুগে দেখা গেছে, সাংবাদিকের সত্য কলমের চেয়ে শক্তিশালি আর কোনো হাতিয়ার নেই। বাংলাদেশ যে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে তা থেকে এককভাবে শুধু সরকারের পক্ষে দেশকে টেনে তোলা সম্ভব নয়। দেশের দিন বদলাতে হলে চাই স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকতা।

বাংলাদেশকে প্রকৃত সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে হলে দুর্নীতিবাজের পোয়াবারো বন্ধ করতে হবে। যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, যে সমাজে ঘুষকে ‘স্পিড মানি’ হিসেবে প্রকাশ্যে বৈধতা দেয়া হয় সে সমাজের অচলায়তন ভাঙা চাট্টিখানি কাজ নয়। দিন বদলের এই কঠিন সংগ্রামে সাংবাদিকরাই হতে পারেন সত্যিকারের লড়াকু সৈনিক বা ত্রাতা তথা সুপার হিরো।

লেখক :
আফরোজা সোমা

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। খানজাহান আলী24/7 নিউজ এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আরো সংবাদ