আজ - বুধবার, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - রাত ৮:১২

২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে মৃত্যুবরণ করেন মাহবুব, অসহায় পরিবার।

২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যখন গ্রেনেডের তাণ্ডব তখন শেখ হাসিনাকে নিরাপদে গাড়িতে তুলে দিয়ে ঘাতকের বুলেটবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন বিশ্বস্ত দেহরক্ষী মাহবুব। নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ।

সেদিনের সেই বুলেটটি দেহরক্ষী মাহবুবকে স্পর্শ না করলে কেড়ে নিতে পারত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন।

সেই আত্মত্যাগে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখা হলেও তার অনুপস্থিতি আজ কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়েছে মাহবুবের পরিবারকে। তার মৃত্যু বদলে দিয়েছে পুরো পরিবারের জীবনচিত্র।
মাহবুবের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে। ফুলবাড়ি গ্রামে মাহাবুবের বাবা-মা আর পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজ রাখেন না কেউ।

মাহবুবকে নিয়ে গর্ব, অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই আর কান্নায় গাল ভাসানো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই পরিবারের। বাবা হারুন মোল্লা ছেলে হারানোর শোক আর বয়সের ভারে নেতিয়ে পড়েছেন।

নিহত মাহবুবের দুই ভাই মামুন অর রশীদ ও শাহজাহান আলীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বেসরকারি হোটেল ও গার্মেন্টসে চাকরি দিলেও সেখানে ভালো কিছু করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে আবার খোকসায় ফিরে আসেন।
এক ভাই অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরে।

আরেক ভাই মামুন অর রশীদকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাহবুবের স্ত্রী আসমা বেগম ২ সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। যোগাযোগ নেই মাহবুবের বাবা-মায়ের সঙ্গে।

মাহবুবের অসহায় মা হাসিনা বেগম বলেন, ”এই মাস (আগস্ট) আসলিই কেবল সামবাদিকরা আইসে আরো আমাগো জ্বালা বাড়ায় দেয়। কেউ কি আমার ছেলেকে আইনে দিতি পারবা। আমার কেউ তালাশ নেয় না, আমি কিরম আছি। যা যাওয়ার তো আমারই গ্যাছে আপনারা কি ফিইরি দিতি পারবেন। ”
মাহবুবের বৃদ্ধ বাবা হারুন-অর-রশিদ বলেন, ”আমি যেন মাহবুবসহ সেই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার দেখে যেতে পারি” এ সময় তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ”দলীয় নেতাকর্মীরা আমাদের পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। ”

হামলার কিছুদিন আগে মাহবুবকে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন নেত্রী শেখ হাসিনা। কয়েক দিন ব্যবহার করে স্মৃতিস্বরূপ মায়ের কছে রেখে দেন তার শহীদ সন্তান। আগস্টের ২১ আসলেই মা ঘড়িটি বুকে চেপে কেঁদে ওঠেন আর মাঝে মাঝে মূর্ছা যান।

মাহবুবের ছোট ভাই শাহজাহান বলেন, ”আমার ৫ বোনের মধ্যে ৩ বোনের বিয়ে দিয়েছি মাহবুব থাকতেই। তারপর অবিবাহিত দুই বোনের বিয়ের ভার নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাত্রপক্ষ এসে আমার ছোট বোন শিরিনাকে দেখে পছন্দ করে গেলেও অর্থাভাবে তার বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

মাহবুবের ছোট বোন বিউটি বলেন, ”আমাদের দুই বোনের পড়ালেখার জন্য প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা করে দিতো বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ট্রাস্ট। কিন্তু সেই টাকাও আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আমরা এখন লেখাপড়াও করতে পারছি না। ”
এ সময় তিনি আরও বলেন, ”স্থানীয় এমপি আব্দুর রউফ কয়েকবার আমাদের ভিজিএফ কার্ড করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেননি।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, ”গ্রেনেড হামলায় নিহত মাহবুবের এক ভাইকে খোকসা উপজেলা পরিষদে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যাতে করে তাদের সংসারটা ঠিকমতো চালাতে পারে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেহরক্ষী হিসেবে মাহবুব যোগদান করেন ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে। এর আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক নির্ভীক সেনা, একজন ল্যান্স করপোরাল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মাহবুবের ছুটি ছিল। তারপরও জনসভায় যোগ দিতে ঢাকার বাসা থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে হাজির হন সেখানে। বিকেল ৫টা বাজার কিছু সময় পর শেখ হাসিনার ভাষণ শুরু হয়।

ঠিক এমন সময় জনসভার ওপর পড়তে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। গ্রেনেড হামলায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা তার বুলেট প্রুফ গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাহবুব তাকে গাড়িতে প্রবেশ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু শেখ হাসিনা মাহবুবকে চিৎকার করে বলে, ”না আমি যাবো না, ওরা মারে আমাকে মারুক। ” নেত্রীর সে কথায় কান না দিয়ে মাহবুব বুক দিয়ে আগলে গাড়ির মধ্যে তাকে ঠেলে দেন। আর ঠিক এ সময় ঘাতকের একটি বুলেট তার মাথার পেছন দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকটি গুলি তার বুককে বিদ্ধ করে। সেখানেই পড়ে থাকেন জননেত্রীর দেহরক্ষী মাহবুব। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। ২১ আগস্ট রাতেই মাহবুব মারা যান।

আরো সংবাদ