আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - বিকাল ৩:৪২

যশোর গরীবশাহ্ মাজার অবৈধ দখলমুক্ত করণে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন

খানজাহানআলী 24/7 নিউজ ।। যশোর শহরের বকুলতলাস্ত গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজার অবৈধ দখলমুক্ত করণের উদ্যোগ নিয়েছেন মাজারের বাউল, সাধক, পাগল, ফকির, আশেকানসহ যশোরবাসী। যশোর সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে যশোর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়।

রবিবার (৬ জুন) সকালে গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজার অবৈধ দখলমুক্ত করণ প্রসঙ্গে যশোর জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ তমিজুল ইসলাম খান ও যশোর জেলা পুলিশ প্রলয় কুমার জোয়ারদারের কাছে গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজারের বাউল, সাধক, পাগল, ফকির, আশেকানসহ যশোরবাসীর পক্ষে আবেদনপত্রটি জমা দেন শাহারুল ইসলাম।

গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজারের বাউল, সাধক, পাগল, ফকির, আশেকানসহ যশোরবাসীর পক্ষে আবেদনপত্রটি জমা দেন শাহারুল ইসলাম।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মাজার সরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্, হযরত শাহ্আলী বোগদাদী, হযরত গোলাপশাহ্, মাওলানা সলেমান শেইজি, শাহ্ শরফুদ্দিন চিশতীর মাজার সরকারীকরণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যশোরবাসীও গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজার সরকারী করণের দাবী জানিয়েছেন।

আবেদনপত্রে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে তারা। তারা বলেন, যশোর গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজার শরীফের ১২ শতক জমি রয়েছে। যাহা একটি মূল মাজার নির্মাণাধীন বিল্ডিং এবং কবরস্থান বলে উল্লেখ আছে। জমিটি যশোর মৌজার, জে. এল নং-৮০, দাগ নং-৭০। মাজার নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পার্শ্বের অবশিষ্ট জমিতে অবৈধভাবে কথিত খাদেম দাবিদার শতবর্ষী গাছের ডাল কেটে একটি তিনতলা বিল্ডিং নির্মাণ করিয়াছে এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আশা ফার্নিচার ও ইসলাম ফার্নিচারের কাছে বিক্রি করেছে। তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দীর্ঘদিন যাবৎ মাজারের জমিতে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

গরীবশাহ্ মাজার অবৈধ দখলমুক্ত করণে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন পত্র জমা দেওয়া হয়

তাদের অভিযোগ, মাজারের জমিতে নির্মিত তিন তলা বিল্ডিংয়ের ময়লা আবর্জনাসহ মাজারের তিনপাশ জুড়ে অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য ফেলছেন খাদেম দাবিদার ঐ মহলটি। এতে মাজারের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং মাজারের দর্শনার্থীদের মাজার জিয়ারত করতে অসুবিধা হচ্ছে। মাজারের জমিতে বাউল, সাধক, পাগল, ফকিরদের বসার উদ্দেশ্যে একটি টিনের ছাপড়া করে ওই মহলটি মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালামাল রাখে।

তাদের দাবী, মাজারের বাৎসরিক আয় লক্ষ লক্ষ টাকা তছরুপ করা হয়। যা মাজারের কোন উন্নয়ন সাধণ করেনা। এযাবত যা উন্নয়ন হয়েছে তা গরিবশাহ্ রহমাতুল্লাহ মাজার শরীফ এর ভক্ত আশেকানরাই করেছে। মাজারের বাউল, সাধক, পাগল, ফকির, আশেকানরা প্রতিবাদ করলে তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মারমুখী অবস্থান তৈরি করে মাজারের খাদেম দাবিদার মহলটি ।

আবেদনপত্রে যশোর সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম, যশোর জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক ও যশোর পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদ হোসেন মিলনসহ মাজারের অনেক ভক্ত আশেকানরা যশোরবাসীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন। তারা যশোর গরীবশাহ্ রহমতুল্লাহ মাজার অবৈধ দখলমুক্ত করনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয়ের নিকট আকুল আবেদন জানান।

হযরত গরীব শাহ (র:) এর মাজার সংক্রান্ত তথ্য : –

প্রখ্যাত ধর্মগুরু ও আধ্যাত্নিক সাধক হযরত গরীব শাহ (র:) এর আধ্যাত্ম সাধনা, অলৌকিক কাহিনী, সুগভীর পান্ডিত্বের কথা যশোরবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জানা যায় তাঁর পূর্ব পুরুষ বাগদাদের অধিবাসী। তাঁর পিতামহ কিতাব উদ্দীন বাগেরহাট, যশোর হয়ে মাগুরায় বসতি স্থাপন করেন। মাগুরা নৌহাটা গ্রামে গরীব শাহ দেওয়ানের জন্ম।

এলাকায় এখনো জনশ্রুতি আছে, একবার ব্রিটিশ সরকারের নীলকুঠি ইনচার্জ টমাস টুইডি এলাকার হাজরাপুর দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় হানু নদীর তীরে হজরত গরীব শাহকে দেখতে পেয়ে ভিক্ষুক ভেবে একটি মুদ্রা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মুদ্রাটি হাতে নিয়ে নদীতে ফেলে দেন। টমাস টুইডি এতে রেগে তাৎক্ষনিকভাবে মুদ্রাটি ফেরৎ চাইলে হজরত গরীব শাহ (র:) তাকে হাত পাততে বলেন। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, অসংখ্য মুদ্রায় তার হাত ভরে গেছে। টুইডি তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চান এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

ছোটবেলায় তিনি একই গ্রামের গগন মুন্সির বাড়িতে থেকে লেখাপড়া ও রাখালের কাজ করতেন। এলাকার অনেকেই গরীব শাহকে নিয়ে মালিকের কাছে নানা কথা বলত। একদিন গভীর রাতে গগন মুন্সী তাঁকে পাহারা দেয়ার জন্য ওৎ পেতে রইল। রাত যখন গভীর হয় তখন গগন মুন্সি দেখতে পেলেন বালক গরীব শাহ বিছানা ছেড়ে হানু নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনিও তাঁর পিছু নিলেন। তিনি দেখলেন, গরীব শাহ নদীতে ওজু করে খড়ম পায়ে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে নদীর ওপারে গেলেন। পরদিন তিনি তাঁকে বললেন, আজ থেকে আমি তোমার মনিব নই। এ বাড়িতে তোমার কোন কাজ করতে হবে না। তুমি কেবল বসে বসে খাবে আর ধর্ম পালন করবে।

একবার গরীব শাহের বাড়িতে মেহমান আসবে। মা তাঁকে বললেন, নদী থেকে কিছু মাছ ধরার জন্য। গরীব শাহ তখন ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে মাছ ধরার দোয়ার তৈরি করে নদীতে না বসিয়ে ডাঙায় বসিয়ে রাখলেন। এ দৃশ্য দেখে তাঁর মা এবং এলাকাবাসী তাঁকে বললেন, মানুষ পানিতে মাছ পায় না, আর তুমি ডাঙায় মাছ পাবে কী করে? এ কথার উত্তরে গরীব শাহ নাকি বলেছিলেন, নদীতে মাছ পাওয়া না গেলেও এ ডাঙায় ঠিকই মাছ পাওয়া যাবে। পরের দিন সকালে দেখা গেল যারা নদীতে দোয়ার পেতে রেখেছিল তাদের একটি দোয়ারেও মাছ নেই অথচ গরীব শাহ দেওয়ানের দোয়ারে অনেক মাছ আটকে রয়েছে। এছাড়া গাছের উপরে দোয়ার পেতে মাছ ধরা, নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কলেরা থামানো, হিংস্র বন্যপশুকে পোষ মানানোসহ নানা অলৌকিক ক্ষমতার কথা এখনো লোকমুখে শোনা যায়।

গরীব শাহকে মাত্র ছয়মাসেই বিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু বিয়ের পরপরই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এর পর তিনি আর কখনো সংসারের মায়ায় বন্দি হননি। ধর্ম প্রচারের মাধ্যমেই বাকি জীবন কাটিয়েছেন।

হযরত গরীব শাহ (রঃ) হযরত খান জাহান আলী (র:) এর সহচর ছিলেন। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) বারোবাজার থেকে বাগেরহাটের দিকে যাত্রা করলে অসংখ্য ভক্ত তাঁকে অনুসরণ করেছিল। তিনি গরীব শাহ (র:) ও বাহরাম শাহ (র:) কে ইসলাম প্রচারের জন্য যশোরে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এই দুই শিষ্য যশোরের মুড়লীতে এসে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেছিলেন।

খান জাহান আলী (র:) ভৈরব নদীরতীরে প্রাচীন মুড়লীতে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। ক্রমে ক্রমে সেটি মুড়লী কসবা নামে পরিচিত হয়। কসবা শব্দের অর্থ শহর। মুড়লী কসবা ছিল সেই সময়কার শহর। গরীব শাহ মানুষকে ইসলামের আদর্শ বুঝিয়ে দিয়ে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতেন। হযরত গরীব শাহ (র:) ও হযরত বোরহান শাহ (র) এর চেষ্টায় পুরনো যশোর ঈশ্বরীপুর মুসলিম অধ্যুষ্যিত স্থানে পরিণত হয়েছিল। আস্তে আস্তে স্থানটি কসবা নামে পরিচিত হয় এবং তিনি এই কসবার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি একবার স্রোতবহ ভৈরব নদীকে রাগ করে ভৎসনা করেছিলেন বলে নদীর স্রোত স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল। জনসাধারণ বিশ্বাস করে যে, দরবেশের জন্যই নদীতে আজও স্রোত বহে না।

কথিত আছে যে, খান জাহান আলী (রঃ) তাঁর অন্যতম সঙ্গী হযরত গরীব শাহ (রঃ) কে তৎকালীন খরস্রোতা ভৈরব নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেতুটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হবার পূর্বেই তিনি মারা যান। এই সেতুকে আরবী/ ফারসী ভাষায় জসর বলা হয়। আর এ থেকে এলাকার নাম জসর (যশোর) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

হযরত গরীব শাহ (রঃ) ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দের পঞ্চম পাদের দিকে বাংলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, হজরত গরীব শাহ (র:) একই সাথে সাত জায়গায় দেহত্যাগ করেন। যে কারণে দেশের সাত স্থানে তাঁর মাজার রয়েছে। এর মধ্যে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নৌহাটা গ্রামে, যশোরের বকুলতলায়, ফরিদপুর, বারইঝুঁড়ি এবং বাকি মাজারগুলোর নাম তেমন জানা যায়নি। তবে যশোর এর কেন্দ্রস্থল দড়াটানা মোড়ের সামান্য পশ্চিমে ফৌজদারী কোর্টের উত্তরে বকুলতলায় ভৈরব নদীর তীরে তাঁর মূল সমাধি। সমাধিটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ন্যায় দেখতে। মূল্যবান রঙ্গীন বস্ত্র দ্বারা তাঁর সমাধি সব সময় আবৃত থাকে। ছোট মাজারটি বেশ পরিপাটি ও সুন্দর। সর্বদা ভক্তরা এখানে আনাগোনা করে, গরীব শাহের নামে সিন্নি মানত করে।

ইসলাম প্রচারক হিসাবে তিনি আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তিনি মরেও অমর।

আরো সংবাদ