আজ - শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - বিকাল ৫:২৭

আমার সাথে দাদীর গল্প : প্রসঙ্গ জেল হত্যাকাণ্ড

ডাঃ আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা
আমার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান। আমি আমার দাদাকে শুধু ছবিতেই দেখেছি। দাদার আদর ভালবাসা কিংবা দাদার সাথে কথা বলার সৌভাগ্য আমার ছিল না। আমি তাঁর বড় ছেলে এএইচএম খারুজ্জামানের জেষ্ঠ সন্তান হওয়ার সুবাধে দাদার অনুপস্থিতিতে ’তিতে দাদীর আদর ভালবাসা ও সানিধ্য বেশি পেয়েছি। সে কারণে দাদী আমার সাথে দাদাকে নিয়ে অনেক গল্প ও স্মৃতিচারণ করতেন।

অর্থাৎ দাদার অনেক বিষয়েই দাদীর কাছে থেকে শুনার সুযোগ পেয়েছি। দাদা-দাদীর বিয়ে থেকে শুরু করে , পারিবারিক , রাজনৈতিক প্রভৃতি অনেক বিষয়েই দাদী আমার সাথে কথা বলতেন। বড় হয়ে দাদীর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চাইতাম কিংবা জিজ্ঞেসা করতাম। তখন দাদী স্বল্পস্বরে ছোট ছোট বাক্যে ধীর ধীরেভাবে বলতেন। আমি শুনতাম। দাদীর সাথে আমার চমৎকার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে দাদী তাঁর জীবনের অনেক ঘটনাই আমাকে বলতেন। সেসব একত্রিত করে লিখতে গেলে পরিসর অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে।

তাই দাদীর কাছ থেকে যা শুনেছি এবং জিজ্ঞেস করে জানার সুযোগ হয়েছে সেসবের মধ্যে থেকে কিছু কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার দাদার জন্ম জমিদার পরিবারে। বৃটিশ পতাকা যেমন দেখেছেন, সেই সাথে পাকিস্তান পতাকা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। দাদা স্কুল বয়স থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তা নিয়ে সারাক্ষন ব্যস্ত থাকতেন। দাদীই সামলাতেন সংসার-সন্তানদের। আমার দাদা অল্প বয়স থেকেই তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন ।

দাদী বলেছেন যে, “৭৫ এর সময়ে দাদা কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করতেন। এই সময় তিনি চুপচাপ থাকতেন এবং মাঝে মধ্যেই তাঁকে আনমনার মতো লাগতো”। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পরই দাদা জেলে বন্দী । সাথে তাঁর অন্য তিন সহযোদ্ধাও। চরম প্রতিকুল পরিবেশ। দেশের স্বাধীনতার দুশমনদের অত্যাচার । দাদীকে সন্তানদের নিয়ে থাকার জন্য কেউ বাড়ী ভাড়া দিতেও চাইতো না। এমন অবস্থায় ও দাদী ঢাকাতে ছিলেন। কারণ দাদা ঢাকা জেলে। দাদাকে হত্যার তিন / চার দিন পূর্বে দাদী দাদার সাথে নিয়ম মেনে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

দাদী খাবার রান্না করে দাদার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। দাদী আমাকে বলেছিলেন“ এই দিনের খাবার দাদাকে খেতে দেয়া হয়নি।” তবে দাদার সাথে দাদীর কথা হয় । আর এই কথা বলাই ছিল দাদীর সাথে দাদার শেষ কথা বলা। ঐ দিন দাদা দাদীকে বলেছিলেন “লাইলী আমিতো ৬ ছেলেমেয়েকে এভাবে রেখে গেলাম । মেয়েদের বিয়েও দিয়ে যেতে পারলাম না।”

দাদী প্রতি উত্তরে বলেছিলেন “ দিয়ে যেতে পারলাম না মানে কি? আপনিতো আছেনই। কোন সমস্যা নেই , আমরা একসাথে তাদের বিয়ে দেব। ” উত্তরে দাদা বলেছিলেন “ ৃ আসলে আমার মনে হচ্ছে না যে, আমার ফেরা হবে। তোমাকে ওদের খেয়াল রাখতে হবে। তবে এইটুকু খেয়াল রাখবা যেন কোন লোভ লালসায় কেউ আমাদের মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দিলে সেসব ছেলেদের কাছে বিয়ে দিবে না।ৃ আমার দুই ছেলেকে রেখে গেলাম ; তাদের পড়াশুনার খরচও আমি রেখে যেতে পারলাম না। তোমাকে একটু কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে হবে। ” দাদী বলেছিলেন “ এইসব কথা গুলো বলেই দাদীর সামনেই দাদার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল। ” দাদী বলেছিলেন “ এর কয়েকদিনের পরেই খবর আসে দাদা আর নেই।”

দাদার হত্যাকাণ্ডের পর অর্থাৎ দাদার চলে যাওয়ার পর দাদী তাঁর সন্তানদের নিয়ে রাজশাহীর মালো পাড়ার বাড়ীতে থাকতেন। তাঁর দুই ছেলে অর্থাৎ আমার বাবা ও ছোট চাচা ইন্ডিয়াতে লেখাপড়া করতেন। দাদার দাফনে তাদের অংশগ্রহনের সুযোগ হয়নি। দাদীর কাছে থেকে জেনেছি যে “ ছেলে মেয়েদের নিয়ে সেসময় কত কষ্টে চলতে হয়েছে তা বলে বুঝানো যাবে না। সেসময় মাসিক সাংসারিক খরচ ৫০০/- টাকাও তাকে জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ।

ফুফু ও দাদীর কাছ থেকে শুনেছি যে সংসার চালানোর জন্য শাড়ী গহনা থেকে শুরু করে অনেক কিছু বিক্রি করতে হয়েছে । সেসব বিক্রি করে যে খুব একটা বেশি টাকা পাওয়া যেত তাও না। তবে তখন এ টাকা কয়টাও খুব প্রয়োজন ছিল। সে থেকেই বুঝা যায় তিনি কিভাবে সন্তানদের নিয়ে জীবন সংগ্রাম করেছেন। বাড়ীর পানির লাইনের কাজের থেকে বেচে যাওয়া ভাংড়ী প্রভৃতিও বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছে। আর এভাবে তিনি ছয় সন্তানকে মানুষ করেছিলেন। দাদার কথা দাদী রেখেছেন।

সন্তানদের বুঝতেও দেননি । মালোপাড়ার যে বাড়ীতে তিনি সন্তানদের নিয়ে থাকতেন , সেই সময় বাসার এমনই করুণ দশা ছিল যে দাদী বলতেন“ যখন বৃষ্টি আসত ঘরের মধ্যে থাকা কষ্ট হয়ে পড়ত, ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়ত। আমি মেয়েদের নিয়ে বালতি বাটি ইত্যাদি দিয়ে পানি আটকানোর ব্যবস্থা করতাম।”

অথচ তাঁর স্বামী ছিলেন এদেশের বড় মন্ত্রী ও নেতা। সেই সময় আরেকটি প্রতিকুল পরিবেশও দাদীকে পড়তে হয়েছে। আর তা হলো রাজশাহীর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমার ফুফুদের প্রথম প্রথম ভর্তি নিতে রাজি হতো না। এরূপ কত যে প্রতিকুল পরিবেশের সাথে দাদীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। তাই দাদী অনেক সময় বলতেন “ এখনও আমি তোর দাদার রাজনীতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।” কিভাবে পালন করছেন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন “ তোর দাদা তো মৃত্যু বরণ করেন নি, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে এবং এসব হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড । তোর দাদার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ছেলে মেয়েদের নিয়ে আমার কঠিন সংগ্রাম কী রাজনীতির মধ্যে পড়ে না।” সত্যিই তো আমার দাদী ছয় সন্তান নিয়ে সারাটা জীবন দাদার রাজনীতির অংশী হয়ে রাজনীতিই করে গেলেন।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত