মুখাবয়ব দেখে যে কারও কাছে শিশুই মনে হবে তাকে। আসলে মোটেও শিশু নন তিনি। যদিও ‘শিশু বক্তা’ হিসেবে তিনি বিভিন্ন মাহফিলে অংশ নিচ্ছেন। নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন; নানা মীমাংসিত বিষয়কেও এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সমাজে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুযুক্তি দিয়ে মানুষের ধর্মান্ধতাকে উস্কে দিচ্ছেন তিনি। তার এসব বক্তব্য বিতর্ক সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘শিশু বক্তা’ হিসেবে হঠাৎ পরিচিত হয়ে ওঠা এই ব্যক্তির প্রকৃত নাম রফিকুল ইসলাম মাদানী। নামের সঙ্গে ‘শিশু বক্তা’ বিশেষণ যুক্ত করার ব্যাপারে তার অবশ্য আপত্তি রয়েছে। কিছুটা অস্বাভাবিক খর্বকায়, বালকসুলভ চেহারা ও কোমল কণ্ঠস্বর তার। নিজের ভাষ্যমতে, ‘১৯৯৫ সালে আমার জন্ম। কে বলছে আমি শিশু? আমার বয়স ২৬ বছর।’ বিভিন্ন সময়ে ওয়াজে তার নামের সঙ্গে ‘শিশু বক্তা’ বিশেষণ ব্যবহার না করার অনুরোধও করেন তিনি। যদিও এই শব্দ-ভূষণ ব্যবহারের সুবিধা অনেকদিন থেকেই নিয়ে আসছেন তিনি।
ইউটিউবে অনেক ওয়াজই রয়েছে রফিকুল ইসলাম মাদানীর। সেখানে একটি মাহফিলের ভাষণে জঙ্গিদের হাতে নিহত লেখক অভিজিৎ রায় ও ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের ‘আমাদের ভাই’ বলে সম্বোধন করেছেন তিনি। এসব মামলায় জঙ্গিদের ফাঁসির রায় হয়েছে। কিন্তু সে রায় কার্যকর না করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবি করেছেন এই ‘শিশু বক্তা’। তিনি এও বলেছেন, ‘এরশাদ শিকদারের মতো খুনিরা ফাঁসির রায় শুনে কাঁদে। আমার মুজাহিদ ভাইয়েরা ফাঁসির রায় শুনে হাসতে হাসতে মিডিয়ার সামনে কথা বলে।’
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আলোচনায় আসেন রফিকুল। ওই দিন রাজধানীর শাপলা চত্বরে মোদিবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল থেকে এই ‘শিশু বক্তা’কে আটক করে মতিঝিল থানা পুলিশ। তবে কয়েক ঘণ্টা পরেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সেদিন মুক্তাঙ্গনে মোদিবিরোধী বিক্ষোভ করে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ। ওই বিক্ষোভে যোগ দেন রফিকুল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রফিকুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনায়। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হলেও পরে তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও নূরানি, হেফজ পড়েন। এরপর আট বছর কিতাবখানায় পড়েন। মাদ্রাসার ছাত্র থাকার সময় বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করতেন রফিকুল। তিনি দাওরায়ে হাদিস পড়েছেন রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায়। একই সঙ্গে তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অঙ্গসংগঠন যুব জমিয়তের নেত্রকোনা জেলার সহসভাপতি। নেত্রকোনার পশ্চিম বিলাশপুর সাওতুল হেরা মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছেন ‘শিশু বক্তা’।
রফিকুলের নামের শেষে ‘মাদানী’ শব্দ যুক্ত করা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সাধারণত সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তাদের নামের সঙ্গে ‘মাদানী’ যুক্ত করা হয়। অভিযোগ, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করেই নিজের নামের সঙ্গে ‘মাদানী’ শব্দ যুক্ত করেছেন তিনি। এরই মধ্যে ‘মাদানী’ শব্দ প্রত্যাহার করতে রফিকুলকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী। তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফুল হাসান খান গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই নোটিশ পাঠান।
বিতর্কিত বক্তা হওয়ায় রফিকুল ইসলামকে ওয়াজকারী বক্তাদের সংগঠন রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশের সদস্য করা হয়নি। বরং সংগঠনটির পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন সময় অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এক ওয়াজ মাহফিলে মিজানুর রহমান আজহারির সমালোচনা করে নিজের প্রকৃত বয়স সম্পর্কে কথা বলেন রফিকুল। তিনি বলেন, ‘আমাকে শিশু বক্তা বানিয়ে রাখা হয়। আজহারি সাহেবেরা যদি ইসলামের প্রকৃত খেদমতকারী হয়, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নাই। আজহারি সাহেব ১৯৯২ সালে জন্ম নিয়েছেন। আর আমি ১৯৯৫ সালে জন্ম নিয়েছি। তাহলে এখনও আমাকে শিশু বক্তা বানিয়ে রাখবেন কেন? আমাদের বয়সের মাত্র তিন-চার বছরের ব্যবধান। আল্লাহতায়ালা বানাইছে। দেখতে এমন লাগে। আমার করার কিছু আছে? এ জন্য আমি শুকরিয়া আদায় করি।’