পাকিস্তানের সরকার এখন সেনাবাহিনীর সহায়তায় গিলগিট-বালতিস্তানকে দেশের পঞ্চম প্রদেশে পরিণত করার পরিকল্পনা করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। যা বহু বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিসি) রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৫তম অধিবেশনের সাইডলাইনে ইউনাইটেড কাশ্মীর পিপলস ন্যাশনাল পার্টির (ইউকেপিএনপি) পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত ‘গিলগিট-বালতিস্তানকে পঞ্চম প্রদেশ করার আঞ্চলিক প্রচেষ্টা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এই শঙ্কার কথা জানান।
ইউকেপিএনপির চেয়ারম্যান শওকত আলী কাশ্মীরি বলেছেন, ১৯৭৩ সালের পাকিস্তান সংবিধান অনুসারে কোনো সেনা জেনারেল রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশ আহ্বান করার অধিকার রাখেন না। তবুও জেনারেল বাজওয়া পাকিস্তান আর্মির সদর দপ্তরে বিরোধী দলগুলোর বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদকে ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা গিলগিট-বালতিস্তানকে পঞ্চম প্রদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই এবং এর জন্য আমাদের একটি সাংবিধানিক সংশোধনী করা দরকার। আপনারা (রাজনীতিবিদরা) এর বিরোধিতা করেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি এক ধরনের সতর্কতা এবং হুমকিও ছিল। সেই বৈঠককালে শেহবাজ শরীফের মতো যারা জেনারেল বাজওয়ার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেননি, তাদের কারাগারে রাখা হয়েছিল এবং আরো অনেক নেতার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল।’
পাকিস্তানের মন্ত্রী আলী আমিন গণ্ডাপুর ঘোষণা করেছিলেন যে সরকার গিলগিট-বালতিস্তানকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদেশের মর্যাদায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শিগগিরই এই অঞ্চলটি পরিদর্শন করবেন এবং এ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করবেন।
গিলগিট-বালতিস্তান দখল করার পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের জবাবে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল সামরিকভাবে দখল করার পাকিস্তানের যেকোনো পদক্ষেপের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই এবং এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সব সময় পরিষ্কার এবং ধারাবাহিক আছে।’
যদিও ১৯৫৬, ১৯৬৩, ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ সালের পাকিস্তানের কোনো একটি সংবিধানই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) এবং গিলগিট-বালতিস্তানকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবু এখনো উভয় অঞ্চলকেই নিজেদের প্রদেশে পরিণত করতে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, বিশেষ করে গিলগিট-বালতিস্তান।
১৯৮৪ সালে গিলগিট-বালতিস্তান একটি স্টেট সাবজেক্ট রুলও বাতিল করে দেয়, যার ফলে এই অঞ্চলে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন ঘটেছিল, কারণ পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের লোকেরা সেখানে জমি কিনতে পারে না।
পাকিস্তান এরই মধ্যে গিলগিট-বালতিস্তানের স্বায়ত্তশাসিত অবস্থানকে আধা-স্বায়ত্তশাসিত করে তুলেছে এবং এখন এটিকে একটি প্রদেশে পরিণত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, এই পদক্ষেপটি জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ সংশোধনীর পর যে অপমানের মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান, তার তীব্র প্রতিক্রিয়া।
ইউরোপীয় ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক (ইএফএসএএস) জুনায়েদ কুরেশি বলেছিলেন, ‘আমি অনুভব করি যে এটি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের ৫ আগস্ট (২০১৯) পদক্ষেপের একটি বিড়ম্বিত প্রতিক্রিয়া। এক বছর ধরে পাকিস্তান চেষ্টা চালিয়ে আসছে, এটি উত্থাপন করেছে জাতিসংঘ এবং এমনকি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মেও ইস্যুটি আমরা দেখেছি। তবে তুরস্ক, মালয়েশিয়া এবং চীন ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করেনি এবং এর মূল কারণ হলো, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই (গিলগিট-বালতিস্তানের কাছে)।
এই ষড়যন্ত্রের পেছনে চীনের প্রভাবও বিবেচিত হচ্ছে। নেতাকর্মীরা বলছেন যে চীন দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলটিকে তার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাকিস্তানের কাছে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে সিপিইসি প্রকল্পের আকারে যে বিপুল বিনিয়োগ করেছে তা রক্ষা করতে পারে।
শ্রীনগরের বাসিন্দা জুনায়েদ বলেছিলেন, ‘এটি করার পেছনের মূল উদ্দেশ্য, গিলগিট-বালতিস্তানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে চীন। বেইজিং চায়, কমপক্ষে সিপিইসি তৈরি হচ্ছে যে এলাকায়, তার আইনগত এখতিয়ার পাকিস্তানের হাতে থাকুক এবং এটি কমপক্ষে পাকিস্তানের সংবিধানে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। যাতে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে পারে।
তবে পাকিস্তানের সংবিধানের ২৫৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ যখন আমাদের সঙ্গে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেবে, শুধু তখনই আমরা তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
অঞ্চলটিকে পঞ্চম প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তান আগামী ১৫ নভেম্বর গিলগিট বালতিস্তানে তথাকথিত আইনসভায় নির্বাচন করার পরিকল্পনাও করছে।
সূত্র : ইয়াহু নিউজ।