এ অবস্থায় পিতা ও মাতা সংসদ সদস্য হলে তার পরিবারের ছেলে কিংবা মেয়ে অথবা মেয়ের জামাইকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার নীতি থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা। মাঠ পর্যায়ের তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কথা মাথায় রেখেই দলকে পারিবারিক ক্ষমতা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে একাধিক নেতা জানান।
এদিকে আসন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে যাচ্ছে দলটি। বাবা সংসদ সদস্য হলে সেক্ষেত্রে ছেলেকে উপজেলার নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে অনেকের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে ছেলে যদি ত্যাগী, সৎ ও গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তাভাবনা রয়েছে। আর যদি ছেলে ত্যাগী না হন শুধু এমপি কিংবা মন্ত্রীর ছেলে হলেই তাকে মনোনয়ন দেয়া যাবে না। এসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চান দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে। সকল বলয় ও সিন্ডিকেট ভেঙে শুধু আওয়ামী লীগ ও নৌকার বলয় থাকবে। যাদের যোগ্যতা আছে, সৎ মনোভাব নিয়ে দলের জন্য কাজ করছে তারাই ভবিষ্যতে দলের মনোনয়ন পাবেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ড অথবা স্থানীয় সরকার বোর্ড কখনো পারিবারিক কোনো কিছু মনে রেখে নমিনেশন দেয় না। আমাদের নমিনেশন দেয়ার প্রধান তিনটি কাইটেরিয়া আছে। এলাকার জনপ্রিয়তা-গ্রহণযোগ্যতা, এলাকার সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা, যে দায়িত্ব তিনি পালন করবেন সেই দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা। এখন আমরা আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছি, সেটি হলে মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যক্তি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আছেন কি-না। এই চারটি বিষয়ে বিবেচনা করেই নমিনেশন দেয়া হয়ে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখানে সাবেক ও বর্তমান এমপিদের আত্মীয়দের যদি ভালো লাগে তাহলে তাকে দেয়া হয়। এবার দেখেছি, পরিবার থেকে অন্যরা ভালো, যিনি ভালো তাকেই দেয়া হয়েছে।’
জানা যায়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মন্ত্রী-এমপিরা কার্যত দলের কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করতে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-শ্যালক-বোন-ভাগ্নে-ভাগ্নি-চাচা-ভাতিজা-ফুফা-ফুফুসহ আত্মীয়স্বজনকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে ব্যস্ত থাকেন। নিকটাত্মীয় এরকম অনেককে বসিয়ে সাধারণ নেতা-কর্মীদের দলের নেতৃত্ব থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এছাড়া সারা দেশেই পরিবারতন্ত্র, এমপি লীগ ও নির্দিষ্ট একজন নেতা বলয় তৈরি করেছে। সংসদ সদস্যরা নিজেদের পরিবারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতেন নামমাত্র। বিভিন্ন কমিটি করার ক্ষেত্রে ‘পরিবারতন্ত্র’ দেখা যায়। উপজেলা পর্যায়ে একই চিত্র হওয়ায় দলীয় রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নেতা-কর্মীরা এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে সংগঠন। এমন অবস্থায় জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন নির্বাচনের দলীয় প্রতীক দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবার বা আত্মীয়করণের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সংগঠনকে গণমানুষ ও সকল নেতা-কর্মীর মূল্যায়ন করতে চায় দলের হাইকমান্ড।
জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনের সব ক’টিতেই প্রয়াত সংসদ সদস্যদের পরিবারের সদস্যসহ স্বজনরা আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। একটি ছাড়া বাকি চারটি আসনেই মনোনয়ন পেয়েছেন প্রয়াত সংসদ সদস্যদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা।
বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা বলেন, পরিবারের সদস্যদের অপকর্ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েই তাদের মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। বাবা সংসদ সদস্য হলে তার পরিবার থেকে চেয়ারম্যান পদে কাউকে মনোনয়ন না দেয়ার বিষয়ে চিন্তা করছে আওয়ামী লীগ। সব যদি একই পরিবারের দেয়া হয় তাহলে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করব কীভাবে। দলে তাদের ভ‚মিকা আমরা অস্বীকার করছি না। তবে অন্যদেরও সুযোগ দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলছেন, দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় অধিকাংশ এমপিরা একাধিক বার ক্ষমতায় রয়েছেন। শুধু তিনি এমপি হয়েছেন এতেই শেষ নয়, তার সন্তানকে উপজেলার চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এখন সময় এসেছে নীতি পরিবর্তনের। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন এবং তার প্রমাণ দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, ‘আগে মনোনয়নের বেলায় প্রয়াত এমপিদের পরিবার প্রাধান্য পেলেও এবার প্রার্থীদের ভাবমূর্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।’
সম্প্রতি ঢাকা-৫, পাবনা-৪ ও নওগাঁ-৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে যথাক্রমে কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, নুরুজ্জামান বিশ্বাস ও আনোয়ার হোসেন হেলালকে। বাকি ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১-এর প্রার্থী ঘোষণা না হলেও মনোনয়ন চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের একাধিক নেতা। তারা হলেন যথাক্রমে হাবীব হাসান ও তানভীর শাকিল জয়।
দলীয় সূত্র জানায়, দেশের চার জেলা পরিষদ, ৯ উপজেলা এবং ৬১ ইউনিয়ন পরিষদের আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়ার শেষ দিন গতকাল রবিবার। দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে উল্লিখিত নির্বাচনগুলোতে দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিতরণ শুরু করে আওয়ামী লীগ। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ধানমণ্ডির কার্যালয় থেকে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পেরেছেন। শনিবার পর্যন্ত মোট ১১৮ জন নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহ করেছেন।
জানা গেছে, এবার প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় এমপিরা কোনো রকম হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন না। এমনকি দলের যেসব জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক একই সঙ্গে মন্ত্রী কিংবা এমপি- তারাও মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে যুক্ত হতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অনেক জায়গায় দেখা গেছে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। নিজস্ব লোকজন দিয়ে কমিটি ভর্তি করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মীরা, পরীক্ষিত কর্মীরা কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন। এটা কোনো অবস্থাতেই হতে পারে না। সেটা আরো খোঁজখবর নিয়ে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
সূত্রঃ মানবকণ্ঠ