আজ - রবিবার, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শরৎকাল), সময় - সন্ধ্যা ৬:৩৪

দাঁড়িয়ে শিক্ষকতা করেছেন ৩১ বছর ৩১ বছরে ১ দিনও ছুটি নেননি শিক্ষক সুফিয়া ইয়াসমিন

যশোর জেলা শহর থেকে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের স্কুল বলা যায়। স্কুলের নাম আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের সকল শখ, আহ্লাদ ও ইচ্ছা সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজে বিয়ে পর্যন্ত করেনি। ৩১ বছর চলমান চাকরি জীবনে একদিনও ছুটি নেননি এই শিক্ষক। তা অর্জিত হোক আর বাৎসরিক। কাটাননি অসুস্থতাজনিত ছুটিও। এছাড়া নাম ডাকা থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ক্লাস নেন দাঁড়িয়ে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে ৩১ বছর শিক্ষাকতা জীবনে কখনো তিনি বসে ক্লাস নেননি। বলছি ওই স্কুলের সহকারি শিক্ষক সুফিয়া ইয়াসমিনের কথা।
সুফিয়া ইয়াসমিন সদর উপজেলার ছিলুমপুর গ্রামের মৃত আদম আলী সরদার মেয়ে।
ব্যতিক্রমী আপাদমস্তক এই শিক্ষাগুরু আর কদিন বাদেই যাবেন অবসরে। রোদ কিংবা ঝড়-বৃষ্টি, যাই হোক না কেনো, স্কুলে আসেননি সুফিয়া ইয়াসমিনের, এমন রেকর্ড নেই। গেলো প্রায় ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে সরকার নির্ধারিত’র বাইরে ছুটি কাটাননি একটি দিনও।

সুফিয়া ইয়াসমিন জানান, ১৯৮৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পাশের ছয় বছর পর ১৯৯৩ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন উক্ত বিদ্যালয়ে। কর্মজীবনে কখনও ফাঁকি দেবেন না, এই ব্রত ছিল তার। সে অনুযায়ী কাজ করতে করতে স্কুলই হয়ে ওঠে তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। আপনজন মারা গেলেও ক্লাস বন্ধ করেনি কখনো। মাঝে মধ্যে মনে হয় শরীরটা একটু অসুস্থ কিন্তু যখন স্কুলে আসি তখন আমার আর তেমন কিছু মনে হয় না।
শিক্ষক জানান, ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল সামাজিক কাজ করার। শিক্ষাকতা করার পাশাপশি সামাজিক কাজ করে চলেছেন তিনি। ইচ্ছা শক্তি ও তার কোন পিছুটান না থাকায় এটা হওয়া সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষক সুফিয়া আরো জানান, ১৯৯৬ সালের ১ অক্টোবর তার বাবা ও ২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল তার মা মারা যাওয়ার দিনেও স্কুলে করেছেন তিনি।
বিয়ে কেন করেনি ও কেন কোনদিন বসে ক্লাস নেয়নি জানতে চাইলে তিনি জানায়, বিবাহ করলে সমাজসেবা করতে পারবে না এবং অসহায় শিক্ষার্থীদের সেবা করতে পারবে না এ জন্য বিয়ে করিনি। এবং এ স্কুলের শিক্ষার্থী হওয়ার কারনে কখনো বসে ক্লাস নেননি। কারন ওই চেয়ারে বসে তার শিক্ষকরা ক্লাস নিতো, তায় তিনি ওই চেয়ারে কোনদিন বসেনি।
স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাইসা কবি রোজা জানায়, ম্যাম আমার দেখা সেরা শিক্ষকের একজন। আমাদের কোন বিষয় বুছতে সমস্যা হলে ম্যামের কাছে গেলে ম্যাম আমাদের আবার ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। আমি ম্যামের আইডল হতে চাই।
বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র রমজান আলী বলেন, ‘ম্যাম অন্যরকম মানুষ। আমাদের বাংলা ২হয় পত্র পড়ান। কোনো কিছু না বুঝলে বার বার বুঝিয়ে দেন। চাকরি শেষে ম্যাম আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, এটা ভাবলেয় খুবই কষ্ট হয়।’
শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা গর্ববোধ করি ম্যামের কাছ থেকে কিছুটা হলেও শিখতে পেরেছি। ম্যাম একদিন ক্লাসে এসে বললো আমি যেমন ক্লাস কামায় না দেয়ার জন্য পুরস্কৃত হচ্ছি, স্বীকৃতিস্বরুপ কিছু পাচ্ছি তোমরাও স্কুল কামায় করবে না। আমি নিজ থেকে তোমাদের স্বীকৃতি দেবো।
এমন একজন ব্যক্তিকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে গর্বিত অন্য শিক্ষকরাও। তারা বলছেন, সুফিয়া ইয়াসমিন শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয়।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ম্যাম তার ভাই ও বোনদের মোট ১৫ জন ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করানোর পর প্রতিষ্ঠিত করেছে। এছাড়া অনেক অসহায় শিক্ষার্থীদের স্কুলের বেতন দিয়ে দিতো ও তার জীবনে অনেক শিক্ষার্থীকে বই কিনে দেছে।’
সাদ্দাম হোসেন আরো বলেন, পরীক্ষার আগে আমাদের নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে খোঁজ খবর নেয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় একজন মহিলা কিন্তু জীবনে কখনো অলংকার ব্যবহার করে নি। সহজ সরল জীবনযাপন করতে পছন্দ করে।
ডাক্তার সাজ্জাদ হোসেন নামে আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, ম্যামকে কখনও ছুটি নিতে দেখেনি। অসুস্থ থাকলেও ম্যাম স্কুলে এসেছেন। ম্যামের দেওয়া শিক্ষা নিয়ে আজ আমরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত। ম্যাম আমাদের আদর্শ।
এ বিষয়ে আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ.জেড.এম পারভেজ মাসুদ বলেন, আমি ১৪ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছি। আমার শিক্ষাকতা জীবনে এমন শিক্ষক কখনো দেখিনি। আমি তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। এছাড়া আমি আমার বন্ধুদের কাছে তাকে নিয়ে গল্প করি।
তিনি আরো জানায়, আমি এ প্রতিষ্ঠানে আসার পর তাকে কখনো দেরি করে আসতে দেখিনি, বসে ক্লাস নিতে দেখিনি ও কোন দিন নৈমিত্তিক ছুটি নিতে দেখেনি। আমরা সবাই যদি এমন সচেতন হতাম তাহলে শিক্ষার মান আরো অনেক ভালো হত বলে আমি মনে করি। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে। সে শিক্ষক সমাজের গর্ব।
আগামি ৩১ মার্চ ২০২৫ সালে চাকরি জীবনের ইতি টানবেন শিক্ষার্থীদের সুফিয়া ইয়াসমিন। অবসরের পরদিন থেকে এ স্কুলের করিডোরে আর হাঁটবেন না তিনি-এ কথা মনে আসতেই চোখ ছল ছল করে ওঠে তার।
উল্লেখ্য, আগামী ৩১ মার্চ ২০২৫ সালে চাকরি জীবনে উতি টানতে চলেছেন শিক্ষক সুফিয়া ইয়াসমিন।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত