আজ - মঙ্গলবার, ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ৭:১০

পরশের কলমে আগস্টের রক্তক্ষরণ

পাঠকের কলাম ডেস্ক : খুব শেখভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হৈচৈ। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মা’র পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন; দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।

এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচীকে বললেন, “ফাতু, আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।”

সেলিম কাকা আর চাচী বাবা-মা’র পাশে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।

মা’র মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সাথে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচীকে বললেন, “ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।”

ওটাই বোধহয় মা’র শেষ কথা। এরপর কি হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচী তখন আমাদের নিয়ে তার ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।

এরপর আর বাবা-মা’র সাথে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আর মারুফ কাকা অন্য একটা গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

এরপর সবকিছু ঠা-া হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচী, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ঐ বাসায় ফিরতে পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই, তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩নং রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল একটা বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নেই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ। এরপর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।

কোনো বাসায় দুই দিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচীদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল। কয়েকটা বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছি।

মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্মেই ছিলাম, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে ও বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারি নাই। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ঐ কান্নার আড়ালে অন্তর্নিহিত কারণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্টে তার বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) এবং চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছে। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচ- মানসিক চাপ ছিল।

আমার চাচীর আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। এবং সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচীর বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়েসি সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল। পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আঙ্কেল। চাচীর মেজোভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা সেলিম কাকা মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরেই তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাকে পাওয়া যায় নাই। এমনকি তার লাশটাও ওরা ফেরত দেয় নাই।

সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাই-বোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবাকান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ তখনো আমদের বলা হয় নাই যে আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।

সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকী বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচী সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাঁক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোণায় ফেলে দেয়।

ঠিক তখনই ওরা গুলি করা শুরু করে। রুমের কোণায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তোবা গুলি তাঁর গায়ে লাগে নাই। ঐ মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেন নাই। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তোবা গুলি লাগার পরে তার আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।

১৫ আগস্টের পরে অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও, আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পরে অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজোফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটা বাসা ভাড়া নেয়। ঐ বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি।
ততদিনে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকাসহ আমার মামারাও (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ) জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কারণ বাংলাদেশে তাদের জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আরামবাগের বাসায় মঞ্জু ফুপার সাথে খেলা করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার মাথা ফেটে যায়। বাসায় ডাক্তার এনে মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। মনে হয় হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না, অথবা সাহস পান নাই নিয়ে যেতে আমার দাদি-ফুফুরা।

যেহেতু চাচা-মামারা ততদিনে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, আমরাও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রস্তুতিটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমত, বর্ডার দিয়ে যেতে হবে, কারণ স্বাভাবিক উপায়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মোশতাক সরকার যদি ধরতে পারে, তাহলে মেরে ফেলবে। নিজের রাষ্ট্র থেকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়, সে অভিজ্ঞতা যে কী পরিমাণ আতঙ্কের হতে পারে সেটা তখন অনুধাবন না করলেও এখন বুঝতে পারি। চিন্তা করলে আমার পরিবারের সবার জন্য বুক ফেটে যায়। সারাজীবন এই দেশটা সৃষ্টি করতে গিয়ে এবং এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন আমাদের দাদু, বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, তার পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক রকম হয়রানিও করেছে পাকিস্তানি সরকার। আর সেই দেশ সৃষ্টির মাত্র তিন বছর পরেই এই কী পরিণতি! এটা কী রকম বিচার!

দ্বিতীয়ত, বর্ডার পার হয়ে যেতে পারব কি না সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পথে পথে ভয়। প্রথম প্রচেষ্টায় আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারি নাই। আগরতলা বর্ডারের একদম পাশে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাদের গবাদি পশুর সাথে গোয়ালঘরে থাকতে দিয়েছিল। তারা আমাদের ধরিয়ে দেওয়া, আর লুট করার পরিকল্পনা করেছিল; দাদি আড়ি পেতে সেই পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়ে পরেরদিন সকালে জিনিসপত্র ঐ বাসায় রেখে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়ে ফেরত আসেন।

(চলমান……. পরবর্তী অংশ আগামীকাল)

লেখক : ১৫ আগস্টের শহিদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির জ্যেষ্ঠ পুত্র। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান
শেখ ফজলে শামস পরশ।

আরো সংবাদ