আজ - সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, (শীতকাল), সময় - সকাল ১০:১৫

বাঁশি বাজালেই মাহাতাবের গায়ে এসে বসে মৌমাছি!

পৃথিবীর বিখ্যাত হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প কে না জানে? তার বাঁশির সুরে গর্ত থেকে বের হয়ে এসেছিল শহরের সব ইঁদুর। প্রায় ৭০০ বছরের বেশি আগে জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিনে ঘটেছিল বিখ্যাত এ ঘটনাটি। গল্পটি লিখেছেন ইয়াকপ গ্রিম ও ভিলহেল্ম গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়। যারা জার্মান পৌরাণিক কাহিনি ও লোককাহিনি সংগ্রহ ও প্রকাশ করতেন। যদিও অনেকের মতে, জার্মানির উত্তর-পূর্বে স্লাভ-অধ্যুষিত অধিবাসীদের ভয়ংকর প্লেগ রোগের কারণে দেশান্তরি হওয়ার বিষয়টিকে বাঁশিওয়ালার প্রতীকী রূপ হিসেবে মনে করা হয়, তবু ঘটনাটি বিশ্ব ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে।

কিন্তু যশোরের অজপাড়াগাঁয়ে বাঁশির সুরে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে এসে বাঁশিওয়ালার গায়ে বসার দৃশ্যটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারও। মৌমাছির ভিড়ে একসময় দেখা যায় না তার শরীর। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন মাহাতাব মোড়লের বাড়িতে। তার এমন দৃশ্য রীতিমতো অবাক করেছে স্থানীয়দের।

নাম মাহাতাব মোড়ল হলেও সবাই চেনে ‘মৌমাছি মাহাতাব’ নামে। যশোরের কেশবপুর উপজেলার হাসানপুর ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবার নাম মৃত কালাচাঁদ মোড়ল। ছোটবেলা থেকেই মৌচাক থেকে মধু আহরণ করতে শুরু করেন মাহাতাব। ওই সময় বালতিতে শব্দ করে চাক থেকে মৌমাছি দূরে সরিয়ে দেওয়ার কৌশলও রপ্ত করেন তিনি। এরপর টিনের থালায় শব্দ শুনে মৌমাছি চাক ছেড়ে তার কাছে আসতে শুরু করে। কাছে আসার এমন দৃশ্য থেকে মধু সংগ্রহকারী এ পতঙ্গের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়।

সুন্দরবনসহ সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন তিনি। আর এই মধু সংগ্রহ করেই তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার চলে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাহাতাব ছোটবেলা থেকে মধু সংগ্রহ করেন। তবে কীভাবে মৌমাছিকে পোষ মানালেন, সেটা সত্যিই অবাক করার বিষয়। মৌমাছির হুল বসানোর ভয়ে মানুষ ভয়ে পালায়। সেখানে তার বাঁশির সুরে শুনে উড়ে চলে আসে মৌমাছি। বিষয়টি অবাক করার মতো।

মাহাতাব মোড়ল জানান, তার বাড়ি ছিল সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলায়। সুন্দরবনসহ  সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে তিনি ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন। মধুর মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছির প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। বাড়ির পাশেই একটি মৌমাছির মৌচাক রয়েছে। বাঁশি বাজালে সুর শুনে হাজারো মৌমাছি এসে বসে। মৌমাছি বসতে বসতে শরীর তার মৌচাকের আকার ধারণ করে। কৌশলগত ওই সুর শুনে এখন হাজারও মৌমাছি তার শরীরে জড়ো হয়। বাঁশি বাজানো বন্ধ করলে মৌমাছি চলে যায়।

মৌমাছি শরীরে কামড় দেয় কি না, জানতে চাইলে মাহাতাব বলেন, এর জন্য শরীরকে আগে থেকেই প্রস্তুত করতে হয়। তাদের আঘাত না করলে একটি মৌমাছিও শরীরে হুল বসায় না। মাহাতাবের মতে, মৌমাছি হিংস্রতা দেখালেও তার কাছে মৌমাছির হিংস্র আচরণ কখনোই চোখে পড়েনি। ভালোবাসায় সব হিংস্রতা জয় করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তিনি জানান, এক বছর ধরে মৌমাছির সঙ্গে কৌশলগত সখ্য থাকলেও মৌমাছির সঙ্গে গভীর প্রেম সেই ছোটবেলা থেকেই। এটি কেবল মৌমাছির প্রতি ভালোবাসা থেকেই করা সম্ভব হয়েছে। এতে কোনো অসৎ উপায় ও তন্ত্র-মন্ত্র নেই। বাড়িতে বাঁশি বাজিয়ে পাঁচ মিনিটেই তিনি শরীরে হাজারো মৌমাছি জড়ো করতে পারেন। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় কোনো ভয় লাগে না বলে জানান তিনি।
 
পোকের (মৌমাছি) সঙ্গে বন্ধুত্ব করার দৃঢ় ইচ্ছা থেকেই মাহাতাব মৌমাছিকে কাছে আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ কাজ দেখতে আসায় এখন খুশি মাহাতাবের স্ত্রী ফুলজান বেগম। প্রথমে তার এই কাজ আমি পাগলামি মনে করে অনেক বকাঝকা করতাম। নিজের মধ্যে খুব ভয় করত। জানি না কখন কী হয়ে যায়। মৌমাছিরা কামড় দিলে তো মারাও যেতে পারে, এই ভয়ে। তিনি এখন অসম্ভব জিনিস সম্ভব করেছে। লোকজন এখন তার এই দৃশ্য দেখতে বাড়িতে ভিড় করে সকাল-সন্ধ্যা। আমার খুব ভালো লাগছে। ফুলজান বেগম পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন থেকে মাহাতাবের এই দৃশ্য দেখতে আসা তোফাজ্জেল হোসেন মানিক বলেন, আমি শুনেছি মাহতাব নাকি বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছি নিয়ে আসেন। তাই দেখতে এসেছি। এত দিন শুনেছি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প, আজ নিজ চোখে দেখলাম মৌমাছির বাঁশিওয়ালা। এখন দেখার পরে বিশ্বাস করছি এই বাঁশিওয়ালার গল্প। এখানে এসে বুঝলাম মানুষ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে।

প্রতিবেশী সালাম হোসেন জানান, মাহাতাব দীর্ঘদিন ধরে মধু সংগ্রহ করে আসছেন। মধু সংগ্রহের ফলে মৌমাছি সম্পর্কে তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে এই মৌমাছির সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। বাঁশি বাজিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়িয়ে তার শরীরে নিয়ে আসেন। সরাসরি এই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না কেউ।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মোশাররফ হোসেন জানান, মাহাতাব যখন বাঁশির সুর তোলে, তখন সারা শরীরে মৌমাছি উড়ে এসে মাহাতাবের শরীরে জড়ো হয়। দৃশ্যটি দেখে হতবাক হয়েছি। তবে মাহাতাবের এই কাজের মধ্যে কোনো কৌশল বা লুকোচুরি আছে কি না, বলতে পারব না।

কেশবপুর উপজেলার হাসানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রভাষক জুলমত আলী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাহাতাব মধু সংগ্রহ করে বেড়ান। কৌশল আয়ত্ত করে তিনি বাঁশির সুরে মৌমাছি তার শরীরে আনেন শুনেছি। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ তার বাড়িতে আসছে এ দৃশ্য দেখতে। তবে আমি কখনো সরাসরি দেখিনি।

যশোর সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নার্গিস শিরীন বলেন, মৌমাছিদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা আছে। তারা ওই ভাষাতেই একে ওপরের সঙ্গে কথা বলে। তবে বাঁশির সুরে মৌমাছি আকৃষ্ট হয়, এটা আমার জানা নেই। আমি বইপুস্তকেও এটা পাইনি। বাঁশির সুরে মৌমাছি আকৃষ্ট হয়ে মানুষের গায়ে উড়ে এসে বসে, এটার সুযোগ নেই।

তবে মৌমাছিরা তো মধুর ওপর আকৃষ্ট হয়, তাই কেউ যদি তার শরীরে মধু, হরমোনযুক্ত সুগন্ধি স্প্রে করে, তখন উড়ে এসে মৌমাছিরা বসতে পারে বলে জানান তিনি।

আরো সংবাদ