আন্তর্জাতিক ডেস্ক:রাখাইন রাজ্যে এমন নীতিতেই চলছে মিয়ানমার সরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবৈধভাবে বসবাস করা ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করা হয়। এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেদেশে বাস করা হিন্দুদেরও নাগরিক মানতে নারাজ মিয়ানমার।
২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া সহিংসতায় এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। সেনাবাহিনীর বরাতে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সেনা অভিযানে কমপক্ষে ৩৭০ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী নিহত হয়েছে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ জন, দু’জন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছেন সহিংসতায়। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান এখনও চলছে। এই অভিযানে হত্যা, গণধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগও উঠেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
সহিংসতা থেকে বাঁচতে এখনও দলে দলে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন রোহিঙ্গারা। শুরুর দিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠালেও রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বাড়তে থাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমানা খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত এক সপ্তাহে প্রায় ৩৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
নাফ নদীতে ভাসছে মরদেহ
শুক্রবার ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদীতে ভেসে এসেছে ১৬ রোহিঙ্গার মরদেহ। মরদেহের অবস্থা দেখে বাংলাদেশের সীমান্ত কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, দুই-তিন দিন আগে তাঁদের হত্যা করে মরদেহ পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে।
এর আগে, বৃহস্পতিবার টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপে উদ্ধার করা হয় ১০ শিশু ও নয় নারীর মরদেহ। বুধবার নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে নিহত চার রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করে বাংলাদেশ পুলিশ।
গত কয়েকদিনে সীমানা অতিক্রম করে পালানোর সময় ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে মর্টার ব্যবহারের কথাও জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ৩৩ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালেই মারা গেছেন গুরুতর আহত দু’জন।
হিন্দু? না ওরা মুসলিম?
মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। সংবিধানে তাঁদের কোনো নাগরিকত্বও নেই। ফলে সরকার সবসময়ই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দু’সপ্তাহ আগেই একটি প্রতিবেদন জমা দেয় কফি আনান কমিশন। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার পথ উন্মুক্ত করা, অবাধ চলাচল, মতপ্রকাশের সুযোগ দেয়াসহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। তবে সে প্রতিবেদন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না অং সান সু চি-র সরকার। বরং জাতিসংঘ একটি স্বাধীন তদন্ত দল পাঠাতে চাইলে, ভিসা দেয়া হয়নি দলের সদস্যদের।
তবে এবারের সহিংসতায় শুধু রোহিঙ্গা মুসলিমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা নয়। রাখাইন রাজ্যের মংডুতে বাস করা কয়েকশ’ হিন্দু পরিবারকেও ছাড়তে হচ্ছে দেশ। গত দু’দিনে অন্তত সাড়ে চারশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ-শিশু সীমানা পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। আরো দুই শতাধিক হিন্দু নাগরিক আটকা পড়েছেন নো-ম্যানস’ ল্যান্ডে।
রোহিঙ্গা সংকটে এ ঘটনা অনেকটাই নতুন। হিন্দু শরণার্থীরা বলছেন, ২৫ আগস্ট রাতে যখন রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি – এআরএসএ, তখন কিছু কালো কাপড় পড়া কিছু লোক আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ও ছুরি হাতে মংডুর ফকিরাবাজার, রিক্তাপাড়া এবং চিকনছড়ি গ্রামেও হামলা চালায়। এখনও কালো কাপড় পরিহিতরা সেই গ্রামগুলিতে অবস্থান নিয়ে আছে। তাদের হামলায় অন্তত ৮৬ হিন্দু গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি করছেন শরণার্থীরা।
ঠিক কী কারণে, কারা এই হামলা চালাচ্ছে, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন হিন্দু শরণার্থীরা। একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে সশস্ত্র দখলদার, এই সহিংসতা থেকে বাঁচতে দলে দলে বাংলাদেশে আসছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও।
মিয়ানমার সরকার রাখাইনের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও মিয়ানমারের অধিবাসী বলে মনে করে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করায় নিজেদের বার্মিজ বলেই দাবি করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। কিন্তু পরিচয়পত্রে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে তাদেরও জাতীয়তা হিসেবে দেখানো হয় ‘ইন্ডিয়ান’।
এদিকে, মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে উত্তর রাখাইনের সহিংসতা কবলিত এলাকা থেকে ১১ হাজার সাতশ’ ‘আদিবাসীকে’ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। উত্তর রাখাইনে ‘আদিবাসী’ বলতে অমুসলিম বার্মিজদের বুঝিয়ে থাকে মিয়ানমার সরকার।
বৃথা বৈঠকে জাতিসংঘ
যুক্তরাজ্যের আহ্বানে বুধবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠকে বসে জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক কার্যত শেষ হয়েছে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। চলমান সহিংসতার নিন্দা জানালেও আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ।
কূটনীতিকরা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘের আরো শক্ত ভূমিকা রাখার পথে বাধা চীন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট হিসেবে দেখে, সেখানে এখনই জাতিসংঘের হস্তক্ষপের প্রস্তাবে এর আগেও ভেটো দিয়েছিল চীন।
বৈঠক শেষে জাতিসংঘে ব্রিটিশ দূত ম্যাথিউ রাইক্রফট সাংবাদিকদের জানান, ‘‘অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রই সংকট নিরসনে অং সান সু চি-র ওপরই ভরসা রাখতে চায়। এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের পথে তাঁর উন্নতি আশাব্যঞ্জক। ”
তবে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট বেশ জোরেসোরেই আলোচনায় উঠবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। চীনের অনানুষ্ঠানিক সমর্থন সত্ত্বেও বড় ধরনের চাপের মুখেই পড়তে হতে পারে মিয়ানমারনে।