যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটিতে সম্মেলন কেন্দ্র বা অ্যাম্ফিথিয়েটার করা হয়েছিল সম্মেলন, সভাসেমিনার করার জন্য। কিন্তু সেটা এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেয়া হয়। বর্তমানে পার্কটি চলছে লিজের মাধ্যমে। লিজ গ্রহিতারা যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটিতে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন। এতে নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আইসিটি শিল্পের বিকাশ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি পথচলা শুরু করে। পার্কটিকে ঘিরে চাকরি প্রত্যাশীদের স্বপ্ন ছিল এখানে প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি কোম্পানি আসলে তাদের চাকরি হবে। পার্কটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সফটওয়ার উৎপাদন করে রফতানি করা হবে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য আর সফল হয়নি। যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটিতে কোনো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি আসেনি। বেশিরভাগই এসেছে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা। এতে হতাশ এ অঞ্চলের মানুষ।
২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করেন। যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরের কিছু বেশি জমিতে পার্কটি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা। এটি চালুর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছিলেন, যশোর হাইটেক পার্ক হবে শিক্ষিত বেকার যুবকদের স্বপ্নের কর্মস্থল। কিন্তু পার্কটি উদ্বোধনের ৩ বছর পার হলেও কোনো কাজে আসেনি। এখন সেটি ভবন সর্বস্ব। কোনো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানতো আসেনি, বরং যারা ছিল তারা চলে যাচ্ছে। আইটি পার্কটি ভাড়া দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহরের বেজপাড়া-শংকরপুরে স্থাপন করা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এলাকায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃষ্টিনন্দন ও সুউচ্চ দুটি ভবন। এর একটি মূল ভবন ও অন্যটি আবাসন সুবিধার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে আরো দুটি ভবন। সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এলাকার মধ্যেই এক পাশে স্থাপন করা হয়েছে জাতীয় ডাটা সেন্টারের ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টারটি। ১৫ তলা মূল ভবনে গিয়েও দেখা যায়, বিভিন্ন তলার অধিকাংশ স্থান এখনো অব্যবহৃত।
পার্কটিতে বর্তমান বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল মার্কেটিং, কল সেন্টার পরিচালনা ও গ্রাফিকস ডিজাইনিংয়ের কাজ করেন। কর্মসংস্থানের লক্ষ্য পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেনি পার্কটি। বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ পার্কটি ছেড়েছেন। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত ডরমিটরি বা আবাসনসুবিধা খালিই থাকছে।
বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম সাংবাদিকদের বলেছেন, যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়ার পার্কে বিনিয়োগকারীদের নানা চাহিদা আছে। ভাড়া মওকুফ, বিদ্যুৎ বিল মওকুফসহ অনেক কিছুই তারা দাবি করছেন। বিনিয়োগকারীদের সব চাওয়া সঠিক নয়। ‘বড় প্রতিষ্ঠান আসার চেয়ে সফটওয়্যারের কাজ হবে, তেমনটাই কথা ছিল। বড় প্রতিষ্ঠান এলে তাদের আমরা উৎসাহ দেব। বড় প্রতিষ্ঠান না আসায় সেভাবে পার্কটি জমজমাট হয়নি।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন পর্যন্ত যশোর হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। পার্কটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেক সিটি জানিয়েছে, সেখানে ৫০টি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে কার্যক্রমে রয়েছে ৩২টি।
পার্কটির মূল ১৫ তলা ভবনে ১ লাখ ৩৭ হাজার বর্গফুট জায়গা ইজারাযোগ্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়া প্রায় ৯৫ হাজার বর্গফুট। ৩টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে ফেলে রেখেছে। ফলে ৩৮ শতাংশ জায়গা এখনো খালি রয়েছে। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানও হয়নি। মোট ১ হাজার ৪০০ কর্মী সেখানে কাজ করেন বেসরকারিভাবে। তবে প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচ হাজার কর্মীর কাজ পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই প্রশিক্ষণধর্মী। তারা বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণের কাজ করে। সফটওয়্যার তৈরি করে, এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ছয়টি, যা হলো মাইক্রো ড্রিম আইটি, টেকনোসফট বাংলাদেশ, সফট এক্স টেকনোলজি, ডেসটিনি আইএনসি ডট, সেমিকোলন আইটি ও অংশ ইন্টারন্যাশনাল। কিছু প্রতিষ্ঠান কল সেন্টার পরিচালনা, ডিজিটাল বিপণন, গ্রাফিকস ডিজাইনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে।
সূত্র জানায়, পার্কটিতে বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই। ডেসটিনি আইএনসি ডট নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে জাপানি বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তারের এন সল্যুশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে যশোর হাইটেক পার্কে। তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যশোর হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করবে। তাদের মাধ্যমে আমরাও শিখব। কিন্তু কিছুই হয়নি।’ এখন নিজের প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কায় আছি।
৩ বছরে ১৭টি প্রতিষ্ঠান যশোর হাইটেক পার্ক ছেড়েছে। আপন ফ্রিডম, ওয়াটার স্প্রিডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা যেসব প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে একটি বড় সমস্যা দক্ষ জনবল না পাওয়া। ইজারামূল্য নিয়ে বিরোধ, উন্নত ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ সেবা না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা বলছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি ইউনিট প্রতি ১৪ টাকা হারে বিদ্যুত বিল দিতে হচ্ছে তাদের। এতে তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সরকারের যেসব স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়, তাতে কোনো দক্ষ কর্মী তৈরি হয় না। ২০১৭ সালে যশোর পার্কে বেশ আয়োজন করে চাকরি মেলা করা হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীদের বিপুল আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু সেখান থেকে জনবল তৈরি হয়নি।
সে সময়ে যশোর পার্কের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বর্তমান যুগ্ম সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম (বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত)। তিনি বলেন, ‘অনেক তরুণ সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এটা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের, তাই সবার আবেদন নেয়া যায়নি।’
যশোর হাইটেক পার্কটিকে ১৫ বছরের জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে টেকসিটি বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। তাদের নিয়ে বিনিয়োগকারীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। অন্যতম হলো ইজারামূল্য। কোনো প্রতিষ্ঠানের বর্গফুটপ্রতি ১৮ টাকা, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২২ টাকা ভাড়া নেয়া হয় বলে অভিযোগ। সূত্র জানিয়েছে, ছয়টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের ভাড়া ৪ মাসের বেশি বকেয়া রয়েছে। অবশ্য যারা হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিল, তাদের ভাড়া পড়েছে বর্গফুটপ্রতি ১৪ টাকা।
মাইলাইটহোস্টের সত্বাধিকারী রকিবুর রহমান বলেন, অন্যদের চেয়ে আমাদের বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। চুক্তির মেয়াদও দুই বছর, যেখানে তাদের সঙ্গে বিএইচটিপিএ চুক্তি করেছে পাঁচ বছর মেয়াদে। এসব বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
টেকসিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুর রহমান বলেন, যেটা ভেবে হাইটেক পার্কের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য। এত বড় একটা অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনার খরচ অনেক। অনেক কিছু হিসাব না করেই সরকার সেখানে ভাড়া নির্ধারণ করেছিল। বিনিয়োগকারীদের অনেকে ভাড়া দিচ্ছেন না। তাদের কাছে কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকা ভাড়া বাকি।
যশোর হাইটেক পার্কে ডরমেটরিটি তিন তারকা মানের। মোট কক্ষ ৯০টি। ভিআইপি সুইট কক্ষ ১২টি, ফ্যামিলি ডিলাক্স কক্ষ ৩৬টি ও দুই বিছানার কক্ষ ৩০টি। ১৪০ জনের মতো থাকার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ভিআইপি কক্ষে থাকার জন্য প্রতি রাতের ভাড়া ৭ হাজার ৬০০ টাকা ও অপর দুই ধরনের কক্ষের ভাড়া ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে। তবে পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাড়া নির্ধারিত আছে ৮০০ টাকা।
কথা ছিল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, ক্রেতা ও কর্মীরা গেলে ডরমেটরিতে থাকবেন। যদিও এখন বেশির ভাগ কক্ষ সব সময় খালি থাকে। মাসে গড়ে ৬০-৭০ জন অতিথি থাকে।