যশোরে আলাউদ্দিন হত্যাকাণ্ডে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বারান্দীপাড়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী ফিঙে লিটনের ছোট ভাই ডিম রিপনসহ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। গতকাল রোববার এই মামলায় গ্রেপ্তার সাইদুল ইসলাম শুভ আদালতে জবানবন্দিতে এই ধরনের বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেছে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। শুভ শহরতলীর ঝুমঝুমপুর কুমারপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে।
সাইদুল ইসলাম শুভ জানিয়েছেন, গত ২৬ নভেম্বর মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের এসআই আনোয়ার হোসেন আসামি সাইদুল ইসলাম শুভকে গ্রেপ্তার করে পরদিন আদালতে সোপর্দ করেন। এরপর শুভকে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আলাউদ্দিন হত্যা রহস্য প্রকাশ করতে চায়। রোববার দুপুরের আগে শুভকে রিমান্ডে নেয়ার কিছুক্ষণ পরই তাকে আদালতে আনা হয়। আর এদিনই তিনি আলাউদ্দিনকে কারা, কেন ও কিভাবে হত্যা করেছে সেই বিষয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে এজাহারভুক্ত সকলেসহ আরো কয়েকজনের নাম বলেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এদিনই শুভকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বারান্দীপাড়ার একটি সূত্র মতে, নিহত আলাউদ্দিন যশোর শহরের আরবপুর এলাকার কলুপাড়া বাবুর বাড়ির ভাড়টিয়া শুকুর আলীর ছেলে। তিনি বিভিন্ন সময় মাদক ও চুরি-ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। যে কারণে তার বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। সেই মামলায় হাজতবাসের পর গত জুলাই মাসে জামিনে মুক্ত হন আলাউদ্দিন। তার পিতার বাসা আরবপুর এলাকায় হলেও চলাফেরা বারান্দীপাড়া কেন্দ্রিক। বারান্দীপাড়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী ফিঙে লিটন পরিবারের সাথেই তার ওঠাবসা বেশি। যে কারণে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ অপকর্মে ফিঙে লিটনের ভাই ডিম রিপন তাকে শেল্টার দিয়ে থাকে। পাশাপাশি ফিঙে লিটনের ভগ্নিপতি বারান্দীপাড়ার মাসুদুর রহমান নান্নু অনুগত আলাউদ্দিনকে দিয়ে বিভিন্ন লোকের জিনিসপত্র চুরি, মাদক ও অস্ত্রের কারবার করিয়ে থাকে।
স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, যশোরের বারান্দীপাড়ার বাসিন্দা বদর উদ্দিনের ছেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী আনিচুর রহমান ফিঙে লিটন দেশের বাইরে থাকলেও যশোরে তার অপরাধ সিন্ডিকেট রয়েছে সক্রিয়। ফিঙে লিটনের ছোট ভাই ডিম রিপন এবং ভগ্নিপতি মাসুদুর রহমান নান্নুর নেতৃত্বে ১৫/২০ জনের একটি সিন্ডিকেট চুরি ছিনতাই, অস্ত্রবাজি, বোমাবাজি, চাঁদাবাজি ও হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। ঝুমঝুমপুর এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম শুভ, আরবপুরের শুকুর আলীর ছেলে আলাউদ্দিন কালু, বারান্দীপাড়া টাওয়ার মোড়ের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শাহারাজ, শামিমের ছেলে শরীফ, একই এলাকার বাপ্পি ও হেদায়েতসহ বেশ কিছু উঠতি বয়সের যুবক ছেলেরা ওই সকল অপকর্ম করে বেড়ায়।
জানা গেছে, গত রমজান মাসে মণিহার এলাকার একটি মসজিদের সামনে থেকে ফল ব্যবসায়ী রবুর একটি পালসার এবং আশরাফ নামের এক ব্যক্তির একটি এফজেড মোটরসাইকেল চুরি করে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। চুরি করা মোটরসাইকেলের টাকা আলাউদ্দিনের কাছে ছিল। মাসুদুর রহমান নান্নু টাকা নেয়ার জন্য আলাউদ্দিনকে ফোন করেন। কিন্তু চোরের উপর বাটপাড়ি করে নান্নুর ভাগ্নে সিরাজুল ইসলাম সিরার ছেলে জিতু টাকাগুলো নিয়ে নেয়। এতে জিতুর উপরও ক্ষিপ্ত হয় নান্নু। পরে নান্নু বিষয়টি তার শ্যালক ডিম রিপনকে জানায়। ডিম রিপন আবার ফোন করে তার ভগ্নিপতি সিরাকে বলেছে জিতু যদি টাকা ফেরৎ না দেয় তাহলে তাকে পুলিশে দেয়া হবে। ফলে পুুলিশের ভয়ে জিতু টাকাগুলো ডিম রিপনের মাধ্যমে নান্নুকে দেয়। কিন্তু আলাউদ্দিন টাকা দেয়ার বিষয়টি নান্নু চাপ দিচ্ছে এমন কথা লোকজনের কাছে বলে বেড়াচ্ছে। এতে নান্নু এবং ডিম রিপনের মানসম্মানের হানি হচ্ছে বলে মনে করে। ফলে ভগ্নিপতি নান্নুকে টাকার দেয়ার বিষয়টি আলাউদ্দিন লোকজনকে জানানোয় তার উপর ক্ষিপ্ত হয় ডিম রিপন। এক পর্যায় আলাউদ্দিনকে খুন করতে নান্নুর পরামর্শে পরিকল্পনা করে ডিম রিপন। ঘটনার দিন ১৭ জুলাই সকালে শাহারাজের মোবাইলে আলাউদ্দিনকে ডেকে নেয়া হয় বারান্দী মালোপাড়া মদন কুমারের বাড়ির কাছে। সেখানে ডিম রিপনের উপস্থিতিতে আলাউদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। এরপর লোক মাধ্যমে খবর পেয়ে আলাউদ্দিনের পিতা শুকুর আলী হাসপাতালে ছেলের লাশ সনাক্ত করেন। এই ঘটনার পরদিন শুকুর আলী বাদী হয়ে ডিম রিপনসহ ৭জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামা আরো ৩/৪ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় পিচ্চি রিপনকে পুলিশ আটক করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ডিম রিপনকে আটকে কোন তৎপরতা নেই পুলিশের। ফলে ঝিমিয়ে পড়ে মামলার তদন্ত কার্যক্রম। এ কারণে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডি পুলিশের উপর ন্যাস্ত করেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন আগে এই মামলার অপর আসামি শুভকে আটক করে সিআইডি পুলিশের এসআই আনোয়ার হোসেন। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে ডিম রিপনসহ আরো এজাহারভুক্ত তিনজন।
নিহতের পিতা শুকুর আলী বলেছেন, ঘটনাটি কারা ঘটালো এবং জেল থেকে কারা কেন আলাউদ্দিনকে মুক্ত করেছিলো এই বিষয়টি তিনি আজো জানেন না।
আলাউদ্দিনের পিতা আরো বলেছেন, ‘একটি অভিযোগ পেয়ে আলাউদ্দিনকে কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১ জুলাই সে জেল থেকে মুক্তি পায়। তালবাড়িয়া এলাকার এক ব্যক্তি আলাউদ্দিনকে মুক্ত করেছিলো বলে শুনেছি! কেন করা হয়েছিল তাও জানি না। ১৭ জুলাই আলাউদ্দিন খুন হয়। তাকে জেল থেকে মুক্ত করা না হলে খুন হতে হতো না। এই বিষয় নিয়ে তিনি এখনো কারোর সাথে আলোচনা করছেন না ভয়ে পাছে যদি বিপদ হয়।’
এই মামলার আসামিরা হলো, ঝুমঝুমপুর কুমারপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে শুভ, বারান্দীপাড়া টাউয়ার মোড়ের রাজ্জাকের ছেলে শাহারাজ, বারান্দীপাড়া মোল্লাপাড়ার শামীমের ছেলে শরীফ, বদরুদ্দীনের ছেলে ডিম রিপন, শরিফের ছেলে রাজ বাবু, একই এলাকার বাপ্পী এবং হেদায়েত।