আজ - রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, (হেমন্তকাল), সময় - ভোর ৫:১৫

সিনহা হত্যা: ওসি প্রদীপ পা দিয়ে চেপে ধরে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন

কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুলি করার পরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন তিনি। টেকনাফ মডেল থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

সিনহাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে পৌঁছানোর পেছনে ও দায়ী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল বলে প্রতীয়মান হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বুধবার (৭ অক্টোবর) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই প্রতিবেদন উপস্থান করা হয়। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া প্রতিবেদন উত্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন দিয়েছে সেনাবাহিনী। কমিটির এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ৩১ জুলাই আনুমানিক ৯টা ২৫ মিনিটে টেকনাফ থানার আওতাধীন মেরিন ড্রাইভ এলাকায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হন। প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ৩ জুলাই ঢাকা হতে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের ৩ জন শিক্ষার্থীসহ ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও তৈরির জন্য কক্সবাজার আসেন। এবং নীলিমা কটেজ নামক একটি রিসোর্টে অবস্থান করে একমাস ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন।

গত ৩১ জুলাই রাতে শুটিং শেষে সিনহা মো. রাশেদ খান সঙ্গী সাহেজুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে মারিশবুনিয়া পাহাড় থেকে নেমে প্রাইভেটকারে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথিমধ্যে শামলাপুরের আগে বিজিবি চেকপোস্টে তাদেরকে তল্লাশি করার জন্য থামানো হয় এবং পরিচয় নেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়।

আনুমানিক রাত ৯টা ২৫ মিনিটে শলাপুর পুলিশ চেকপোস্ট অতিক্রমের সময় ইন্সপেক্টর লিয়াকত এপিবিএনের ফোর্সসহ সিনহা মো. রাশেদ খানের গাড়ি থামায়। সিনহা মো. রাশেদ খান গাড়ি থামিয়ে তাদেরকে পরিচয় দিলে এপিবিএন সদস্যরা প্রথমে তাদেরকে যাওয়ার জন্য সংকেত দিলেও ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাদের পুনরায় থামান এবং তাদের দিকে পিস্তল লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন।

সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দিকে আসেন। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই ইন্সপেক্টর লিয়াকত খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। ঘটনার আনুমানিক ২০-২৫ মিনিট পর টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

আরও জানা যায়, প্রদীপ কুমার দাস ঘটনালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ মিনিট মেজর (অব.) সিনহা আহতাবস্থায় ঘটনাস্থলে পড়ে ছিলেন। তখনও জীবিত ছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য, ওই পুলিশ চেকপোস্টটি এপিবিএন কর্তৃক পরিচালিত এবং ঘটনার সময় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশের ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা এবং পূর্ব পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে।

এরপর রাতে ১০টায় একটি পিকআপে মেজর (অব.) সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর পিকআপটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, স্বাভাবিক সময়ে ওই দূরত্ব অতিক্রমে ১ ঘণ্টা সময় লাগলেও অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করে মেজর (অব.) সিনহাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে পৌঁছানোর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দুরসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল।

এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনা সদস্যদের পক্ষ হতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে একটি যৌথ তদন্ত আদালত গঠনের জন্য পত্রালাপ করা হয়। এর ফলে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার সঠিক কারণ নিরূপণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে (যুগ্মসচিব) আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

গত ৭ সেপ্টেম্বর যৌথ তদন্ত কমিটি মেজর (অব.) সিনহা হত্যা সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটনের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত আদালত গঠিত হয়, যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

স্থানীয় সূত্র এবং বিভিন্ন মাধ্যম হতে মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাণ্ডের সাথে কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ঘটনার তদন্তের শুরু থেকেই অসহযোগিতা ও বাধা প্রদান করে আসছিলেন বলে জানা যায়।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট মেজর (অব.) সিনহার বোন টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকতসহ মোট ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। এ মামলার তদন্তভার র্যাবের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

৯ জন আসামিকে (৩ জন বেসামরিক ও ৬ জন পুলিশ সদস্য) পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। রিমান্ড শেষে এপিবিএনের তিন সদস্য এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই সঙ্গে তিন বেসামরিক ব্যক্তিও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছে বলে জানা যায়। টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ জবানবন্দি দেননি। আসামিরা কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছে। বর্তমানে মামলাটি র্যাবের অধীনে তদন্তাধীন আছে।

পুলিশের হাতে আটক মেজর (অব.) সিনহার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ এবং সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করা হয়। এই তিন মামলায় সিফাত ও শিপ্রা বর্তমানে জামিনে আছেন।

তদন্ত কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, মো. মোতাহার হোসেন, মো. নাসির উদ্দিন, মো. মহিববুর রহমান এবং বেগম নাহিদ ইজাহার খান অংশ নেন।

এছাড়া বৈঠকে প্রতিরক্ষা সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, আবহাওয়া অধিদফতর ও জরিপ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরো সংবাদ
যশোর জেলা
ফেসবুক পেজ
সর্বাধিক পঠিত